
আ. লীগের ৬৮ বছর: নির্ঝঞ্ঝাট ছিল না পথ চলা
নিজস্ব প্রতিবেদক:আজ ২৩ জুন, ঐতিহ্যবাহী সংগঠন আওয়ামী লীগের ৬৮ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। দলটি এদেশের আন্দোলন-সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। দেশের স্বাধীনতা অর্জনে দলটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ১৯৪৯ সালের এই দিনে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী রোজ গার্ডেন ছিল আওয়ামী লীগের আঁতুর ঘর। রোজ গার্ডেন থেকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে প্রতিষ্ঠিত দল আত্মপ্রকাশ করে দলটি। নির্ঝঞ্ঝাট ছিল না এই পথচলা। মোকাবিলা করতে হয়েছে ঘাত-প্রতিঘাত। দলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পাকিস্তানি সামরিক শাসন, জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন ও শোষণের বিরুদ্ধে সব আন্দোলন-সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আইয়ুবের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকারী ভূমিকা রেখেছে। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে সংগঠনের নাম ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। পরবর্তীতে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে ‘আওয়ামী লীগ’ নামকরণ করা হয়। আওয়ামী লীগের প্রথম সভাপতি ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। প্রথম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শামসুল হক। তৎকালীন সময়ে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।
আওয়ামী লীগের ৬৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর মূল্যায়ন করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক গোবিন্দ্র চক্রবর্তী বলেন, ‘আওয়ামী লীগের প্রতি আমাদের প্রত্যাশা হলো আগামীতে এ অঞ্চলের মানুষের সুখ-দুঃখে পাশে থাকবে। বাংলাদেশকে উন্নয়নের শিখরে নিয়ে যাবে, দেশকে শক্তিশালী ও মানবিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে সক্ষম হবে।’
গোবিন্দ্র চক্রবর্তী আরও বলেন, ‘প্রতিষ্ঠার পর থেকে আওয়ামী লীগ সবময়ই যে সঠিক পথে পরিচালিত হয়েছে সেটা বলা যাবে না। মাঝে মধ্যে দলটি লক্ষ্যচ্যুত হয়েছে। তারপরও আওয়ামী লীগই একমাত্র দল, যার কাছে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে একটি মানবিক রাষ্ট্র কামনা করতে পারি।’
আন্দোলনে সংগ্রামে নেতৃত্বে
১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নানা আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধসহ বহু রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে ঐতিহ্যবাহী দলটি। এটিই ছিল তদানীন্তন পাকিস্তানে প্রথম কার্যকর বিরোধী দল। সেসময় সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্যে আর্থ-সামাজিক কর্মসূচির ভিত্তিতে জনগণকে সংগঠিত করা এবং মুসলিম লীগের বিকল্প গড়ে তোলার তাগিদ সৃষ্টি হয়। এই বাস্তব সংগ্রামের মধ্য দিয়েই আওয়ামী লীগের জন্ম।
ছয় দফা
ছয় দফা আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসের একট গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৯৬৬ সালে ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৬ দফা দাবি পেশ করেন। ছয় দফা দাবির মূল উদ্দেশ্য–পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেল রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং ছয় দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে এই ফেডারেশন প্রতিটি অঙ্গরাজ্যকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করবে। এই ছয় দফা দাবিকে কেন্দ্র করে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন জোরদার করা হয়।
৬৯-এর গণঅভুত্থান
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাজনীতিক সংগ্রামের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ঊনসত্তরের গণঅভুত্থান। এর ফলে এক দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা আইয়ুব খান সরকারের পতন ঘটে এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। এই সময়ে ছাত্রলীগসহ আরও কিছু ছাত্র সংগঠন এক সঙ্গে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে তাদের ঐতিহাসিক ১১ দফা কর্মসূচি পেশ করে। যা মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে শক্তি যোগায়।
৭০-এর নির্বাচনে জনরায়
গণআন্দোলন ও আইয়ুবের পতনের পটভূমিতে ৭০-এর নির্বাচনে কেন্দ্রীয় আইনসভায় (জাতীয় পরিষদ) পূর্ব পাকিস্তান থেকে ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭ আসন লাভ করে আওয়ামী লীগ। ৩১৩ আসন-বিশিষ্ট পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং সরকার গঠনে ও শাসনতন্ত্র প্রণয়নের যোগ্যতা অর্জন করে। প্রাদেশিক পরিষদের আসনের মধ্যে ২৮৮ আসন পায় দলটি। জাতীয় পরিষদের সাতটি মহিলা আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের দশটি মহিলা আসনের সবগুলোতেই জয়ী হয় আওয়ামী লীগ। সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনে আমন্ত্রণ জানানোর পরিবর্তে সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে বাঙালির অধিকার নস্যাৎ করার পথ বেছে নেয়।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ও মুক্তিযুদ্ধের ডাক
অসহযোগ আন্দোলন, ৭ মার্চে দিক-নির্দেশনামূলক ঐতিহাসিক ভাষণ, পূর্ববাংলার মানুষের অকাতরে আত্মদান সত্ত্বেও শান্তিপূর্ণ সব পথ বন্ধ হয়ে যায়। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বাঙালিদের ওপর নৃশংস হামলা চালায়। ১৯৭১-এর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। এখানেও নেতৃত্ব দেয় আওয়ামী লীগ। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর স্বাধীন হয় বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা
স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালের ১৯ জানুয়ারি দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করতে কাজ শুরু করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয় স্বাধীনতার অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ওই সময়ে দেশে না থাকায় তারা প্রাণে বেঁচে যান। জেলখানায় জাতীয় চারনেতাকে হত্যার মাধ্যমে এই সংগঠনটিকে নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টা চালানো হয়। পরে শুরু হয় সামরিক শাসন। এ সময় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও রাজপথে নামে আওয়ামী লীগ। এভাবে বিভিন্ন সময়ে নানা আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে থেকেছে এ দলটি।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ
১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসেন। এ সময় তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে সংগঠনকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেন। দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরে বেড়ান। শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বে নেতাকর্মীরাও নবউদ্যমে সংগঠিত হয়। আবারও শুরু হয় রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রাম। নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অগ্রণী ভুমিকা পালন করে দলটি।
রাষ্ট্র ক্ষমতা
১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জয়ী হয়ে ২৩ জুন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসে। শেখ হাসিনা সরকার গঠন করে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে ঘোষণা দেন। ২০০১ এবং ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পর আরেক দফা বিপর্যয় কাটিয়ে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে তিন-চতুর্থাংশ আসনে বিজয়ী হয়ে আবারও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পায় দলটি। ২০০৮ সালে পুনরায় সরকার গঠন করে শেখ হাসিনা ‘রূপকল্প ২০২১’-এর আলোকে মধ্যম আয়ের সুখী-সমৃদ্ধশালী ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখান। ২০১৪ সালে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভাপতি ‘রূপকল্প ২০৪১’-এর আলোকে বাংলাদেশকে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ, আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে দিনের কর্মসূচি
প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে দিনের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ভোরে কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও দেশব্যাপী দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন। সকাল ৯টায় বঙ্গবন্ধু ভবনে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন।
টুঙ্গীপাড়ার কর্মসূচি
সকাল সাড়ে ৯টায় টুঙ্গীপাড়ায় চিরনিদ্রায় শায়িত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি একটি প্রতিনিধি দল শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করবেন।