
দলকে জেতানোর সব দায়দায়িত্ব যিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, উত্তর প্রদেশ ও উত্তরাখন্ড ছিনিয়ে নিয়ে প্রমাণ করলেন যে, শুধু ৫৬ ইঞ্চি বুকের ছাতিই নয়, তাঁর রাজনৈতিক উচ্চতাও দেশের সবার চেয়ে বেশি। এতটাই বেশি যে এই প্রথম তিন শতাধিক আসন পেয়ে ‘মিনি ইন্ডিয়া’ উত্তর প্রদেশের শাসনভার বিজেপি হাতে নিতে চলেছে। সেই সঙ্গে তারা ছিনিয়ে নিল উত্তরাখন্ডকেও, কংগ্রেসের মুঠো থেকে। সৌজন্যে একজনই— প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
কংগ্রেসের সহসভাপতি রাহুল গান্ধী গত শুক্রবার প্রবল আস্থায় ভর দিয়ে বলেছিলেন, বিহারের মতো উত্তর প্রদেশেও বুথফেরত সমীক্ষা ভুল প্রমাণিত হবে। গণনার গতিপ্রকৃতি যা, তাতে মনে হচ্ছে শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস আগেরবারের জেতা আসনের মাত্র এক-চতুর্থাংশ পাবে। এই প্রথম কংগ্রেসের ভার পুরোপুরি নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন রাহুল। সোনিয়া কোথাও প্রচারে যাননি, প্রিয়াঙ্কা মাত্র এক দিনের জন্য উত্তর প্রদেশে গিয়ে গৃহবন্দী হয়েছেন। হয়তো অশনি সংকেতের আঁচ তাঁরা আগেভাগেই পেয়েছিলেন।
উত্তর প্রদেশ ও উত্তরাখন্ড রাহুলের মুখ পুড়িয়েছে। পাঞ্জাবের জয় কতটা তাঁর কৃতিত্বে আর কতটাই বা প্রদেশ সভাপতি ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংয়ের দৌলতে, সেই আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। গোয়া ও মণিপুর দেয়ালঘড়ির পেন্ডুলামের মতো বিজেপি ও কংগ্রেসের দিকে ঢলে ঢলে পড়ে সন্ধ্যায় থিতু হয়েছে। জাতীয় রাজনীতিতে এ দুই রাজ্যের প্রভাব নিতান্তই কম। কিন্তু আর্যাবর্তে, বিশেষ করে মিনি ইন্ডিয়ায় কংগ্রেসের ব্যর্থতা এতটাই মারাত্মক যে রাজনৈতিক মহলে এই মুহূর্তে প্রধান চর্চার বিষয় নরেন্দ্র মোদির তুলে দেওয়া ‘কংগ্রেসমুক্ত ভারত’ গঠনের স্লোগানটি। মোদি দিনে দিনে কংগ্রেসকে ক্ষীণ কলেবর করে তুলছেন। রাহুলের নেতৃত্বদানের ক্ষমতা নিয়েও সংশয় অতঃপর বাড়বে বই কমবে না। কংগ্রেসের মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে, রাহুলের হাতে দল নিরাপদ কি না।
কোনো সন্দেহ নেই, উত্তর প্রদেশের ফল মোদির রাজনৈতিক সুনামি ছাড়া আর কিছু নয়। এবং খুব সহজেই বলা যায়, ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে মোদি যে ভেলকি দেখিয়েছিলেন, এবার বিধানসভা ভোট যেন ঠিক তারই প্রতিচ্ছবি। বরং এটা বলা ভালো, এবার উত্তর প্রদেশ দখলের কৃতিত্ব তিন বছর আগের সাফল্যকেও ম্লান করে দিয়েছে। তিন বছর আগের ভোট ছিল লোকসভার। প্রধানমন্ত্রী পদে মোদিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো তেমন কোনো চরিত্র অন্য দলগুলোতে ছিল না। কিন্তু এবার উত্তর প্রদেশে তেমন চ্যালেঞ্জার ছিলেন দুজন। অখিলেশ সিং যাদব ও মায়াবতী। রাজ্যবাসীর এটাও জানা ছিল, বিজেপি জিতলে মোদি মুখ্যমন্ত্রী হবেন না। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বিজেপি কাউকে আগেভাগে খাড়াও করেনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিজেপির তিন শর বেশি আসন পাওয়া এটাই প্রমাণ করে, মোদির নেতৃত্বের ওপর মানুষের এখনো আঠারো আনা আস্থা রয়েছে। প্রমাণ করে, নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত তাঁর ভাবমূর্তিকে আরও উজ্জ্বল করেছে। এ-ও প্রমাণ করে, মানুষের ধারণা, মোদির নেতৃত্বে দেশ নিরাপদ।
উত্তর প্রদেশের মানুষ এই প্রথম কেন্দ্র ও রাজ্যে বিজেপির নিরবচ্ছিন্ন শাসন অনুভব করবে। এই অভিজ্ঞতা রাজ্যের মানুষ আগে কখনো পায়নি। ভোটদানের আগে এটা ছিল তাদের একটা পছন্দ। দ্বিতীয় পছন্দ ছিল সমাজবাদী পার্টি ও কংগ্রেসের যৌথ শাসন, যার মুখ্যমন্ত্রী হতে পারতেন অখিলেশ। এই পছন্দকে মানুষ দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। অখিলেশের প্রতি মানুষের একটা সহানুভূতি অবশ্যই ছিল। কিন্তু রাহুলের সঙ্গে তাঁর জোট বাঁধাকে মানুষ মেনে নেয়নি। কংগ্রেসের ভোটাররাও এই জোটে অসন্তুষ্ট ছিলেন। ফলে কংগ্রেসের উচ্চবর্ণের ভোট এবার চলে গেছে বিজেপিতে।
উত্তর প্রদেশে এবার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত যে দুই দল, তার একটি কংগ্রেস হলে অন্যটি বহুজন সমাজ পার্টি। কংগ্রেসের ক্ষতি এতটাই যে ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটে আমেথি ও রায়বেরিলি তারা ধরে রাখতে পারবে কি না সন্দেহ। মায়াবতীর হালও ক্রমেই রাহুলের মতো হয়ে যাচ্ছে। ২০১২ সালের ভরাডুবির পর ২০১৪-তেও মায়াবতী কূলকিনারা পাননি। এবার ক্ষমতায় আসার তাগিদে এক বছর আগে থেকে তিনি কোমর কষে নেমেছিলেন। কিন্তু মোদি নামক সুনামিতে এবারও বানভাসি হলেন। রাহুলের মতো মায়াবতীর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও এর ফলে দাঁড়িয়ে গেল প্রশ্নের মুখে। এই দুই দলের সঙ্গে প্রায় একই পঙ্ক্তিতে বসতে হচ্ছে আম আদমি পার্টিকেও। পাঞ্জাব তাদের কাছে অধরা থাকল। গোয়াতেও দল পড়ল মুখ থুবড়ে।
জাতীয় রাজনীতি অতঃপর কীভাবে প্রভাবিত হবে? প্রথমত, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে মোদিকে অন্য কারও দিকে তাকাতে হবে না। তাঁর ইচ্ছাই হবে শেষ কথা। দ্বিতীয়ত, রাজ্যসভায় বিজেপির সংখ্যালঘু চরিত্রের অবসান ঘটা এখন স্রেফ সময়ের ব্যাপার। তৃতীয়ত, প্রয়োজনীয় আর্থিক সংস্কারের কাজ তিনি প্রায় বিনা বাধায় করতে পারবেন। চতুর্থত, যেসব আঞ্চলিক দল এত দিন ধরে বিজেপির বিরুদ্ধাচরণ করে আসছিল, তারা সেই অন্ধ বিরোধিতায় রাশ টানবে। যেমন পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস। পঞ্চমত, উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ভারত জয়ের পর বিজেপি এবার নজর দেবে দক্ষিণ ভারতে। কর্ণাটক থেকে কংগ্রেসকে উৎখাত করার সঙ্গে সঙ্গে তারা দক্ষিণের বাকি তিন রাজ্যে শাখা-প্রশাখা বিস্তারে মনোযোগী হবে। তারাই যে একমাত্র সর্বভারতীয় দল, কংগ্রেস নয়—এই তাগিদ বিজেপিকে ছোটাবে। কর্ণাটকের পাশাপাশি তাদের নজরে রয়েছে ওডিশা।
এই বিপুল জয়ের অন্য একটি দিকও রয়েছে। ব্যর্থতা বা অসাফল্যের জন্য বিজেপি আর কাউকে দোষারোপ করতে পারবে না। অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ নিয়ে টালবাহানা আরও কঠিন হবে। উন্নয়ন আশানুরূপ না হলে কেন্দ্র ও বিরোধীদের দোষারোপ করার সুযোগও বিজেপির থাকবে না।
মোদির এই নব ক্ষমতায়ন বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের আপত্তিকে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে উপেক্ষা করা এখন তাঁর পক্ষে সহজতর হয়ে উঠতে পারে। পানির অধিকার রাজ্য তালিকা থেকে যুগ্ম তালিকায় নেওয়ার বিষয়ে কেন্দ্রীয় স্তরে যে ভাবনাচিন্তা রয়েছে, তা বাস্তবায়ন করাও সহজতর হবে।