
সহস্রাধিক একর জমিতে বোরো বিনষ্টের পথে
কালিহাতীতে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ইটভাটা নির্মাণ
টাঙ্গাইল সংবাদদাতা: টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে ছুনটিয়া গ্রামে সরকারি বিধি নিষেধাজ্ঞা অমান্য ও ইউনিয়ন পরিষদের নকল ‘অনাপত্তিপত্র’ ব্যবহার করে মেসার্স ভাই ভাই ব্রিকস নামক ইটভাটা নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে এলাকার সহস্রাধিক একর জমিতে বোরো ফসল বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় কৃষকরা। এলাকাবাসীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসন ওই স্থানে ইটভাটার নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিলেও তা অব্যাহত রাখায় এলাকাবাসী ফুসে ওঠছে।
জানাগেছে, কালিহাতী উপজেলার ছুনটিয়া গ্রামের মৃত মুনসব আলীর ছেলে আমজাদ হোসেন ১২৪ নং ছুনটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্নস্থানে ‘মেসার্স ভাই ভাই ব্রিকস’ নামে একটি ইটভাটা নির্মাণের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের টাঙ্গাইল জেলঅ কার্যালয়ে গত বছরের ২৭ অক্টোবর ও চলতি বছরের ২৯ জানুয়ারি ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেন। ইটভাটা নির্মাণের স্থানটি আবাসিক এলাকা, সহস্রাধিক একর দো-ফসলি কৃষি জমি এবং সংলগ্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকায় পরিবেশের বিপর্যয়ের আশঙ্কায় স্থানীয় মো. আবুল কালাম আজাদ ও আব্দুল মোতালেব তালুকদার পরিবেশ অধিদপ্তরের টাঙ্গাইল কার্যালয়ে ইটভাটা স্থাপনের ছাড়পত্র না দিতে আবেদন করেন। পরিবেশ অধিদপ্তর সরেজমিনে পরিদর্শন করে ওই স্থানে ইটভাটা নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিন্তু চতুর আমজাদ হোসেন সহদেবপুর ইউনিয়ন পরিষদের একটি নকল ‘অনাপত্তিপত্র’ তৈরি এবং ওই অনাপত্তিপত্র সংযুক্তির মাধ্যমে ইটভাটা স্থাপনের বিষয়ে উচ্চ আদালতে একটি রিট পিটিশন(নং-১৫২৫/২০১৭ইং) করেন। আবেদনটি শুনানীতে উত্থাপিত না হলেও সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তিনি ইটভাটার নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
নির্মাণাধীন মেসার্স ভাই ভাই ব্রিকস নামক ইটভাটা সংলগ্ন এলাকায় একটি গভির ও ৩০-৩২ টি অগভির নলকূপের অধীনে সহস্রাধিক একর বোর ধান আবাদ করা হয়েছে। ইটভাটাটি চালু করা হলে চাষকৃত ধান বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অগভির নলকূপের মালিক আ. জলিল তালুকদার, আব্দুল মোতালেব তালুকদার, হাসমত আলী, আবু বকর, আব্দুল মফিজ, ওমর মেলেটারি, জসিম উদ্দিন, মোজাফ্ফর হোসেন, বেলাল, খালেমুল, কালাম সহ অনেকেই জানান, সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সম্পূর্ণ পেশীশক্তির বলে জনস্বার্থকে অবজ্ঞা করে মো. আমজাদ হোসেন ইটভাটার নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে চলতি বোর মৌসুমে চাষ করা সহ¯্রাধিক একর বোর ধান বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এছাড়া দো-ফসলি জমিগুলোতে শস্য আবাদও হুমকির মুখে পড়েছে।
১২৪ নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শাহনাজ আক্তার বলেন, টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে স্কুলের পাশ দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের যে সরু রাস্তাটি চলে গেছে ওটাই শিক্ষার্থীদের চলাচলের একমাত্র রাস্তা। একটি ভ্যান বা মোটরসাইকেল গেলেও ধূলা ও কাঁদার কারণে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পাশ কাটাতে হয়। ওই রাস্তা দিয়ে ইট বা মাটির ট্রাক চলাচল করলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসা-যাওয়া করতে পারবেনা। স্কুলের বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থী মাসুদা, রহিম, ইমন, রাশেদুল, মনোয়ারা, লাভলী, সামাদ সহ অনেকেই ইটভাটা নির্মাণ বন্ধ করতে জেলা প্রশাসনের জরুরি হস্তক্ষেপ দাবি করে।
১২৪ নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি মো. আব্দুল মোতালেব তালুকদার জানান, চারপাশে সবুজে ঘেরা দো-ফসলি জমি এবং শিশুদের ছুটে বেড়ানোর জায়গায় ইটভাটা স্থাপনের চেষ্টা করা জাতির মেরুদন্ডে আঘাত করার সামিল। তারা ওইস্থানে ইটভাটা বন্ধের জন্য বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করছেন। তিনি জানান, বিদ্যালয়ের পাঠদান নিয়মিত রাখতে এবং শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে ইটভঅটাটি বন্ধ করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে তারা টাঙ্গাইল প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনও করেছেন। অচিরেই মানববন্ধন কর্মসূচিও পালন করা হবে বলে তিনি জানান।
ইটভাটা নির্মাণকারী মো. আমজাদ আলী জানান, পাশেই একটি ইটভাটা চলতে পারলে নতুন ইটভাটা নির্মাণ করতে বাধা কোথায়? তাছাড়া ইটভাটায় স্থানীয় ৪০০-৫০০ লোকের কর্মসংস্থান হবে। নিষেধাজ্ঞা থাকলেও কেন তিনি নির্মাণ কাজ চালাচ্ছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেই তিনি নির্মাণ কাজ চালাচ্ছেন। তাছাড়া তিনি উচ্চ আদালতে ‘প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা কেন অবৈধ হবেনা’ এ মর্মে রুল জারি চেয়ে উচ্চ আদালতে একটি রিট পিটিশান করেছেন। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের অনাপত্তিপত্র সম্পর্কে তিনি কিছু জানেন না। তার পক্ষে অন্য কেউ করে থাকতে পারে।
সহদেবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জানান, উল্লেখিত স্থানে ইটভাটা স্থাপন করা হলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে, ফসলি জমি ও ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখায় বিঘœ ঘটবে। মেসার্স ভাই ভাই ব্রিকস- এর নামে তিনি কোন ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু করেন নি। আমজাদ হোসেন একজন অসৎ ও জালিয়াত প্রকৃতির লোক। তিনি ইউনিয়ন পরিষদের একটি প্যাড, সিল ও তাঁর স্বাক্ষর নকল করে নিজেই ‘অনাপত্তিপত্র’ তৈরি করে নিয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করে বিস্তিারিত জানিয়েছেন।
পরিবেশ অধিদপ্তরের টাঙ্গাইল কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. আমিরুল ইসলাম খান জানান, মেসার্স ভাই ভাই ব্রিকস নামক ইটভাটা নির্মাণের স্থান পরিদর্শন করেছেন। ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন(নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩-এর ধারা ৮ এর উপ-ধারা ১(ক) ও (ঘ), ৩(ঙ) লংঘন করে ইটভাটা স্থাপনের চেষ্টা করা হচ্ছে। অথচ সরেজমিনে পাওয়া তথ্যে ওই স্থানে ইটভাটা স্থাপনের কোন সুযোগ নাই। সে কারণে পরিবেশ অধিদপ্তরের ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩-এর ধারা ৮ এর উপধারা ২ অনুযায়ী ছাড়পত্র দেওয়ারও কোন সুযোগ নেই। তিনি আরো জানান, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) অঅইন, ২০১৩-এর ধারা ১৮(১) ও ১৮(২) এবং বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫(সংশোধিত ২০১০) এর ধারা ১৫(১) অনুযায়ী দন্ডনীয় ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তিনি জানান, মো. আমজাদ হোসেন স্বউদ্যোগে ইটভাটার নির্মাণ কাজ বন্ধ রেখেছেন বলে মুচলেকা দিয়েছেন। তারপরও ইটভাটা নির্মাণ কাজ চালাচ্ছে বলে তিনি শুনেছেন। এ বিষয়ে মোবাইল ফোনে তিনি মো. আমজাদ হোসেনকে জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলেছেন, উচ্চ আদালতে আবেদন করে তিনি নির্মাণ কাজ চালাচ্ছেন। আদালত যদি নিষেধাজ্ঞা দেয় তাহলে ভাটা ভেঙ্গে নিবেন, ইট পোড়াবেন না।
উপ-পরিচালক আরো জানান, এ বিষয়ে তিনি খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করবেন।