
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে ‘কালিহাতী সাধারণ পাঠাগার’
জাগ্রতবাংলা ২৪ ডটকম: টাঙ্গাইলের কালিহাতী সাধারণ পাঠাগার নারীদের বসার পৃথক সুব্যবস্থা ছাড়াই দীর্ঘ ২৫ বছর যাবত পরবাসী হয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। জৌঁলুস হারিয়ে পাঠাগারটি পত্রিকা পাঠে সীমাবদ্ধ থাকছে পাঠ কার্যক্রম। প্রায় ৮ হাজার বই থাকলেও পাঠক নেই বললেই চলে।
জানা যায়, কালিহাতী উপজেলার প্রয়াত বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী অধ্যক্ষ মানছুরুর রহমানের উদ্যোগে ১৯৯২ সালের ৫ আগস্ট স্থানীয় ছাত্র-জনতার সহযোগিতায় উপজেলা সদরে ‘কালিহাতী পাঠাগার’ প্রতিষ্ঠা করা হয় মানুষের মধ্যে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে। এলাকার সম্ভাবনাময় মানুষের সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশের লক্ষও ছিল পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠার অন্যতম কারণ। প্রথমে ‘কালিহাতী পাঠাগার’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ হয়ে পরবর্তীতে ‘কালিহাতী সাধারণ পাঠাগার’ নামকরণ হয়। পদাধিকার বলে প্রতিষ্ঠাকালীন কার্যকরি কমিটির সভাপতি ছিলেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার শেখ ফজলে এলাহী ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন প্রয়াত মানছুরুর রহমান। কালিহাতী উপজেলা সদরের অফিসার্স ক্লাবের সরকারি ভবন বিনা ভাড়ায় ব্যবহারের মাধ্যমে সুধীজনের দেওয়া মাত্র ৩০০টি বই নিয়ে পাঠাগারটির যাত্রা শুরু। তিনতলা বিশিষ্ট ভবনের নিচ তলায় পাঠাগারটি অবস্থিত। তিনটি কক্ষ পড়ার, দুইটিতে বই রাখার ব্যবস্থা এবং একটি কক্ষ অফিস রুম হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। একটি টয়লেট ও বাথরুম রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, কালিহাতী সাধারণ পাঠাগারটি মূলত পত্রিকা পাঠের জন্য বেশি পরিচিতি পেয়েছে। প্রতিদিন ৩৫-৪০ জন পাঠক এখানে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকা পাঠ করে থাকেন। জাতীয় পত্রিকাগুলোর মধ্যে অধিকাংশই ধনাট্য সদস্যরা কিনে সরবরাহ করে থাকেন। পাঠাগার কর্তৃপক্ষ প্রথম শ্রেণির ৪-৫টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা নিয়মিত রাখেন। স্থানীয় পত্র-পত্রিকাগুলো এখানে মাঝে মাঝে আসে। এছাড়া বিভিন্ন দেশের বুলেটিনগুলোও পাওয়া যায়। পত্রিকা পড়ছিলেন নিয়মিত পাঠক কালিহাতীর হরিপুর গ্রামের গৌরহরি পন্ডিত, বয়স ৭০। তিনি জানান, পত্রিকা পড়ার জন্যই তিনি সপ্তাহে ৫দিন পাঠাগারে আসেন। এখানকার পরিবেশে পত্রিকা পড়ে তিনি স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। কালিহাতী আরএস পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবিদ হাসান, আফতাব হোসেন ইপতি, কালিহাতী কলেজের শিক্ষার্থী শফিকুল ইসলাম শফি, স্কুল শিক্ষক হেলাল উদ্দিন, হাসিনা ফেরদৌসী, কলেজ শিক্ষক তাহমিনা হোসেন লাবনী, কালিহাতী আরএস পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফারিয়া, মীম, তাহমিনার সাথে কথা হয়। তারা জানান, নারীদের পড়ার জন্য পৃথক ব্যবস্থা থাকলে ভাল হয়। বিশেষ করে পৃথক পড়ার টেবিল ও পৃথক টয়লেট থাকা জরুরি। তারা জানান, এখানে ইন্টারনেট সংযোগ নেই। ইন্টারনেট সংযোগের পাশাপাশি ৫-৬টি কম্পিউটর থাকলে পাঠাগারের পাঠক ও সদস্য সংখ্যা আরো বাড়বে। একই সাথে ইসলামী, ইতিহাস ও গল্প-উপন্যাসের বই আরো বাড়ানো দরকার।
পাঠাগারের লাইব্রেরিয়ান সোহেল রানা জানান, পাঠগারে বর্তমানে ৮ হাজারেরও বেশি বই রয়েছে। পাঠাগার বিকাল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সর্বসাধারণের জন্য খোলা থাকে। পাঠাগারের সাধারণ সদস্য সংখ্যা ৩৫০ জন, আর আজীবন সদস্য সংখ্যা ২৬০জন। তিনি জানান, প্রতিদিন পত্রিকা পড়ার জন্য ৩৫-৪০ জন পাঠক আসে। বই পড়া ও নেওয়ার জন্য প্রতিদিন গড়ে ১০-১২জন পাঠক আসেন। তাছাড়া প্রতিদিন ৮-১০জন সদস্য বাড়িতে পড়ার জন্য বই নিতে আসেন। যাঁরা বই পড়েন তারা সাধারণত গল্প-উপন্যাসই বেশি পড়েন। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এখানে গবেষণা করার মতো রেফারেন্সমূলক তেমন বই নেই, তাছাড়া কেউ গবেষণার জন্য এখানে আসেন না।
পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আনছার আলী বিকম জানান, পাঠাগারের লাইব্রেরিয়ান ও একজন পিয়ন খন্ডকালীন হিসেবে কাজ করছেন। সদস্যদের চাঁদা ও অনুদানের টাকা থেকে তাদের খুবই অল্প পরিমাণে বেতন দেওয়া হয়। পাঠাগারের জমানো টাকা ব্যাংক হিসাবে জমা রাখা হয়। এখানকার বেশির ভাগ পাঠক মূলত পত্রিকা পাঠ করে থাকে। পাঠকদের জন্য সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ ব্যবস্থা রাখায় তারা খুব খুশি।
তিনি আরো বলেন, পাঠাগারে একটি কম্পিউটার থাকলেও ইন্টারনেট সংযোগ নেই। পাঠকরা ৫-৬টি কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সংযোগ ও একটি নিজস্ব ভবনের জন্য দীর্ঘদিন যাবত দাবি করে আসছে। অর্থাভাবে তা সম্ভব হচ্ছেনা। ইন্টারনেট সংযোগ ও কম্পিউটরের বিষয়ে তিনি সরকারের এটুআই প্রকল্পের উর্ধতন কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
কালিহাতী সাধারণ পাঠাগারের সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবু নাসার উদ্দিন জানান, তিনি আসার পর পাঠাগারটি দেখে আনন্দচিত্তে কিছুটা সংস্কার করেছেন। চেয়ার-টেবিল ও বইয়ের সংখ্যা বাড়াতে চেষ্টা করেছেন। পাঠাগার পরিচালনার জন্য একটি কার্যনির্বাহী কমিটি রয়েছে। কমিটিই রক্ষণাবেক্ষণ ও যাবতীয় খরচ বহন করে থাকে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং উপজেলা পরিষদ ও উপজেলা প্রশাসনের অনুদানেই মূলত পাঠাগারটি চলছে। এছাড়া স্থানীয় ধনাঢ্য ও শিক্ষানুরাগী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও বিভিন্ন সময় অনুদান দিয়ে থাকেন। সদস্যদের মাসিক চাঁদা ১০ টাকা উল্লেখ করে তিনি জানান, ওই টাকা থেকে পত্রিকা ও বৈদ্যুতিক বিল পরিশোধ করা হয়। তিনি জানান, পাঠাগারটির নিজস্ব কোন ভবন নেই। এ ভবনটি মূলত অফিসার্স ক্লাবের। বিনা ভাড়ায় ভবনটি পাঠাগারকে ব্যবহার করতে দেওয়া হয়েছে। যেভাবে শুরু হয়েছিল এখনও সেভাবেই চলছে। তবে পৃথক একটি নিজস্ব ভবন হওয়া দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।
কালিহাতী সাধারণ পাঠাগারের উপদেষ্টা- কালিহাতী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোজহারুল ইসলাম তালুকদার বলেন, কালিহাতী পাঠাগারটি যেহেতু বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পাঠাগার সেহেতু পাঠাগারটির দ্রুত উন্নয়ন প্রয়োজন। পাঠাগারটিতে উপজেলা পরিষদ থেকে যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করে আসছি। তবে সরকারি তহবিল থেকে সহযোগিতা পেলে পাঠাগারটি প্রসার ও দ্রুত উন্নয়ন হতো। নারীদের বসার সুব্যবস্থা এখনো নেই, নারীদের আলাদা বসার সুব্যবস্থা না দিতে পারলেতো সফলতা আসলোনা। তাই আমরা চেষ্টা করছি যত দ্রুত সম্ভব নারীদের সুব্যবস্থা করার। পাঠাগারটির নিজস্ব স্থান নেই, বর্তমানে বিনা ভাড়া চলছে। আমরা সামনে শিল্পকলার জন্য বিল্ডিং (কমপ্লেক্স) করছি। ওই কমপ্লেক্সের মধ্যেই যেন সরকারিভাগে একটি পাঠাগারের অবকাঠামো গড়ে দেন এবং সে ব্যাপারে কথা হয়েছে, পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। সরকারের প্রতি আমাদের যথেষ্ট ভরসা আছে এবং আশা করছি পাঠাগারের অবকাঠামো করে দেবেন।