
চিত্রনাট্য বিষয়ে সত্যজিতের ভাবনা
বিনোদন ডেস্ক, জাগ্রতবাংলা ২৪ ডটকম: সত্যজিৎ নিজে ছিলেন একজন লেখক। আর তাই চলচ্চিত্রের ব্যাপারে তিনি ছিলেন ভীষণ খুঁতখুতে। বলা চলে, চিত্রনাট্য সম্পর্কৃত কোন কিছু লিখতে লিখতেই পুরো ছবিটা সাজিয়ে ফেলতেন তিনি। চলচ্চিত্র মানে সময়ের চরিত্র, লোকেশনের স্কেচ করে রাখতেন চিত্রনাট্যের পাশাপাশি।
চিত্রনাট্য নিয়ে তার সহজ স্বাবলীল বক্তব্য ছিলো । তিনি বলেছেন, ‘আমি চিত্রনাট্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে গদার এর কথা বলবো না, কারণ এসব পরিচালককে কোন নিয়মের গন্ডির মধ্যে ফেলা যায় না। যারা চিত্রনাট্যের বিষয়ে জানতে চান, তারা যদি এইসব পরিচালক দ্বারা শুরু করেন, তাহলে খুব বেশি লাভজনক হবে বলে আমি মনে করি না। বিশেষত গদারের প্রায় ছবি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে তার একটা লক্ষ্য হল সিনেমার সনাতন রীতিগুলোকে অত্যন্ত সচেতনভাবে ভেঙ্গে ফেলা। কাজেই গদারকে বোঝার আগে জানা চাই এ সনাতন রীতিগুলোকে। চিত্রনাট্যকারের কোনো সমস্যার সঙ্গে সাহিত্যিকের সমস্যার বিশেষ কোন তফাৎ নেই। দুজনের কাজ হলো কোন একটি বিষয়বস্তুকে ভাষায় ব্যক্ত করা। তফাৎ এই যে, সাহিত্যিক কেবল মাত্র কথার আশ্রয় নেন; চিত্রনাট্যকার কিছুটা কথা এবং কিছুটা ছবি ও ধ্বনির মধ্যে দিয়ে তাঁর কথা বলেন’।
সাহিত্য আর চিত্রনাট্যের মধ্যে মূল পার্থক্য সম্পর্কে ‘চলচ্চিত্রের সংলাপ প্রসঙ্গে’ প্রবন্ধে নিজের ভাবনার কথা তুলে ধরেছেন সত্যজিৎ রায়। ১৯৬৩ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় প্রবন্ধটি ছাপা হয়।
চিত্রনাট্যে সংলাপের ব্যবহার প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায় লিখেছেন, ‘চলচ্চিত্রে সংলাপের প্রধানত দুটি কাজ। এক, কাহিনীকে ব্যক্ত করা; দুই, পাত্র-পাত্রীর চরিত্র প্রকাশ করা। সাহিত্যের কাহিনীতে কথা যে কাজ করে, চলচ্চিত্রে ছবি ও কথা মিলিয়ে সে-কাজ হয়।’
চরিত্রের সঙ্গে মিলিয়ে সংলাপ রচনার উপর জোর দিয়েছেন সত্যজিৎ রায়। তিনি লিখেছেন, ‘সংলাপ যদি স্বাভাবিক না হয় তাহলে অভিনয় স্বাভাবিক হওয়া মুশকিল। বাস্তব জীবনে মানুষ একই বক্তব্য বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্ন ভাষায় ব্যক্ত করে। একই কথা অলসমুহূর্তে একভাবে, কর্মরত অবস্থায় আরেকভাবে; এমনকি গ্রীষ্মে ঘর্মাক্ত অবস্থায় একভাবে এবং শীতে কম্পমান অবস্থায় আরেকভাবে ব্যক্ত হয়। নিরুদ্বিগ্ন অবস্থায় মানুষের কথার লয় হয় বিলম্বিত, উত্তেজিত অবস্থায় মানুষের কথা কেটে যায়, বাক্য উত্থিত হয় নিঃশ্বাসের ফাঁকে ফাঁকে’।
পথের পাঁচালীর পূর্ণাঙ্গ চিত্রনাট্য কখনও তৈরি করা হয়নি। থাকবার মধ্যে ছিল শুধু একতাড়া কাগজে লেখা কিছু নোট আর কিছু স্কেচ। ছবিতে কাহিনী কোথায় কীভাবে ফুটবে, সেটা বোঝবার জন্য পূর্ণাঙ্গ চিত্রনাট্যের দরকারও ছিল না তাঁর। সত্যজিৎ বলেন, ‘একে তো পুরো কাহিনীটাই আমার মনের মধ্যে একেবারে গেঁথে গিয়েছিল, তার উপরে আবার ডি.কের করা সারাংশ আর চিত্রনাট্যের মূল উপাদানের মধ্যে সামঞ্জস্য ছিল কম নয়।
ছবির কাহিনী থেকে মূল বইয়ের প্রচুর চরিত্র বাদ দেওয়া হয়। পুরুত ঠাকুর হরিহর রায় ও তাঁর পরিবার, অর্থাৎ তাঁর স্ত্রী সর্বজয়া, মেয়ে দুর্গা, ছেলে অপু, আর বয়সের ভারে ন্যুব্জ এক দূর সম্পর্কের দিদি ইন্দির ঠাকরুন, হরিহরের ছেলেমেয়েরা যাকে পিসি বলে ডাকেবাস, মূলত এই কটি চরিত্রকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে ছবির কাহিনী। ছবির পক্ষে অপ্রয়োজনীয় বলে মূল বইয়ের একটানা অনেক বাগিবস্তার বর্জন করে ঘটনাগুলিকে আমি একটু অন্যভাবে সাজিয়ে নিই, ফলে ছবির কাহিনীতে একটা নতুন বুনট তৈরি হয়ে ওঠে। পিসিটিকে যে আমি আরও অনেক দিন বাঁচিয়ে রাখি, তার কারণ আমি জানতাম যে, নানা রকমের নাটকীয় ঘটনায় ভরা ওই পরিবেশ থেকে যদি হঠাৎ তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয় তো দর্শকদের পক্ষে সেটা একটা নৈরাশ্যজনক ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। মূল বইয়ে অপুর জন্মের কিছুদিন বাদেই তিনি মারা যান। সেক্ষেত্রে ছবিতে তিনি যখন মারা যান, দুর্গার বয়স তখন দশ-এগারো। একটা বাঁশঝাড়ের মধ্যে অপু আর দুর্গা তাঁর মৃতদেহ দেখতে যায়। মৃত্যু যে কী, তা তারা সেই প্রথম জানলো’।
দুর্গার মৃত্যুর ব্যাপারটা নিয়েও একটা বড় রকমের পরিবর্তন ঘটান সত্যজিৎ। জংলা জায়গা, প্রবল ধারায় বৃষ্টি পড়ছে, আর তারই মধ্যে আনন্দে আত্মহারা হয়ে নেচে বেড়াচ্ছে দুর্গা। ফলে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সে মারা যায়। কিন্তু বৃষ্টিতে ভেজার ফলেই যে তার মৃত্যু ঘটল, মূল বইয়ে তা দেখানো হয়নি। ঝড়ের দৃশ্যের পরপরই দূর্গার অসুস্থ হওয়া এটা সত্যজিৎ দেখিয়েছেন।
তাঁর মতে, ‘জঙ্গলের ঝড় বাদলের মধ্যে তার ওই আত্মহারা নাচ, দুর্গার মৃত্যুর প্রত্যক্ষ কারণ হিসাবে এটাকেই আমি তুলে ধরি। দুর্গার মৃত্যুর পরে আমার কাহিনীতে ধীরে ধীরে উপসংহার টানি এবং দেখাই পিতৃপুরুষের ভিটে ছেড়ে হরিহর তাঁর পরিবার নিয়ে কাশীতে চলে যাচ্ছেন’।
সূত্র: অনলাইন