
জীবনের যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুতঃ সংসদে প্রধানমন্ত্রী
নিজস্ব প্রতিবেদক: প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, আমার চলার পথ কখনই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না, কণ্টকাকীর্ণই ছিল। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উৎরাই ও বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে আমাকে এগোতে হয়েছিল। বার বার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও হাল ছাড়িনি। একটা আত্মবিশ্বাস ছিল, আমি তো কোনো অন্যায় করিনি। এ দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাকে সাহায্য করবে। দেশের মানুষও নিশ্চয় বুঝতে পারবে। এই যে ভালোবাসার পরশ, মা-বাবা হারানোর বেদনা তো সেখান থেকেই ভুলে গেছি, আর সেখান থেকেই শক্তি পেয়েছি। এই মানুষগুলোর জন্যই তো আমার বাবা জীবন দিয়েছেন। তাই এদের জন্য জীবনের যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত।
গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদে সংসদ সদস্য ফজিলাতুন নেসা বাপ্পির সম্পূরক প্রশ্নে তিনি এসব কথা বলেন। বক্তব্যের এক পর্যায়ে শেখ হাসিনাকে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়তে দেখা যায়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার উন্নয়নের মহাসড়কে অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য জনগণকে এগিয়ে চলার শক্তি জোগাচ্ছে। উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় লাল-সবুজের নিশানা নিয়ে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আজকের ১৬ কোটি জনগণের আস্থা ও সমর্থনের প্রতীকে পরিণত হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশ ২০৪১ সালের আগেই উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশে পরিণত হবে।
সংসদ নেতা বলেন, কোনো ব্যক্তিগত আকাক্সক্ষা নয়, আজকে ক্ষমতা আমার জন্য ব্যক্তিগত আকাক্সক্ষা পূরণের জন্য নয়। আমি রাষ্ট্রপতির মেয়ে ছিলাম, প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে ছিলাম। আমি নিজে প্রধানমন্ত্রী ছিলাম দুবার। এবারসহ তিনবার। কখনো নিজের ভাগ্যে কী করব সে কথা চিন্তা করিনি। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়েছি, আল্লাহর রহমতে তারাও আমাকে সাহায্য করে। কখনো বিরক্ত করে না, এই ব্যবসা দিতে হবে, সেই ব্যবসা দিতে হবে। এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে। এই ধরনের বিরক্ত কখনই করেনি। দেশের উন্নয়নমূলক অনেক কাজেই তারা সাহায্য করছে। ছোট বোনের মেয়ে টিউলিপ এই নিয়ে দুবার লন্ডনে এমপি হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আজকে মানুষের জন্য যে কিছু করতে পারছি, এটাই আনন্দ। ক্ষমতাটা হচ্ছে মানুষের সেবা করার সুযোগ। সে সুযোগটা যে পাচ্ছি এবং জনগণ যে ভোট দিয়ে আমাকে বার বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত করেছে এবং আমাদের পার্লামেন্টের পার্টি আমাকে তাদের নেতা বানিয়েছে, আমি প্রধানমন্ত্রী হয়ে দেশের সেবা করতে পারছি, এটাই তো সবচেয়ে বড় পাওয়া। তিনি বলেন, আমি গ্রামের পর গ্রাম হেঁটেছি। সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। পেয়েছি সাধারণ মানুষের ভালোবাসা। উঠোনের রাস্তায় ডাব কেটে দিয়ে বলেছে, মা এটা খাও। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শুধু বলেছে, বাবা জীবনটা দিয়ে গেছে তুমিও পথে নেমেছো মা? তুমি পথে নামছো আমাদের জন্য?
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বিদেশে থাকার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, পাঁচটি বছর রিফিউজি হিসেবে বিদেশের মাটিতে আমাদের থাকতে হয়েছে। রিফিউজি হিসেবে অন্য দেশে থাকা এটা যে কতটা বেদনাদায়ক ও কষ্টকর, আমরা তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি। জাতির জনকের হত্যাকা-ের প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, আমি ও আমার ছোট বোন একদিনেই নিঃস্ব-রিক্ত হয়ে যাই। এই শোক ও ব্যথা সহ্য করা যায় না। তবে এই শোক ও আঘাত আমি ও আমার বোনের ভেতরে শক্তি জুগিয়েছে। মানুষের ভালোবাসার পরশ থেকে শক্তি পেয়েছি। মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছি। চীন হতে সাবমেরিন কেনার বিষয়ে বলেন, এটি বাংলাদেশের একটি জাতীয় স্বার্থকেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত এবং এর ফলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বহির্বিশ্বে কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে না বলে বিশ্বাস করি।
দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ
প্রধানমন্ত্রী বলেন, রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নের লক্ষ্য পূরণের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মানুষের আয় বেড়েছে, সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে। বাংলাদেশ আজ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো দীর্ঘতম সেতু নির্মাণ করার সাহস নিতে পেরেছে। একটি মানুষও গৃহহীন না থাকার প্রত্যয়ে আশ্রয়ণ প্রকল্প ও একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাচ্ছে। ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো জ্বালিয়ে আমাদের সরকার প্রতিটি নাগরিকের মনে আকাক্সক্ষার প্রদীপ জ্বালিয়ে তুলছে। নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বে প্রশংসিত বাংলাদেশ। তিনি বলেন, ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে আওয়ামী লীগ সরকার ঘোষণা করে রূপকল্প-২০২১, যার মূল উপজীব্য ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা আন্তর্জাতিকমহলে সমাদৃত প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সজীব ওয়াজেদ জয়। তারুণ্যের মেধা ও শক্তিকে ইতিবাচক কাজে লাগানোর এক অনবদ্য ও বাস্তবায়ন শুরু হয়। ঘোষিত সময়ের আগেই বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে এসেছে। বিশ্বব্যাংকের মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় স্থান পায় বাংলাদেশ। অর্থনীতিবিদরা একে দেশের ধারাবাহিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাফল্যের অনন্য স্বীকৃতি হিসেবে অভিহিত করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশকে বিবেচনা করা হতো উন্নয়নের টেস্ট কেস হিসেবে আর আজ বাংলাদেশ সারাবিশ্বের কাছে উন্নয়নের বিস্ময়ে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোলমডেল হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার আধুনিক রূপই হচ্ছে আজকের ডিজিটাল বাংলদেশ। রূপকল্প-২০২১ এর অধীনে ঘোষিত সময়ের আগেই একটি সুখী, সমৃদ্ধ, স্বনির্ভর বাংলাদেশ বিনির্মাণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন পূরণের জন্য আওয়ামী লীগ আজও নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। যে মশাল বঙ্গবন্ধু জ্বালিয়ে রেখে গিয়েছিলেন ৪২ বছর আগে, তার সুযোগ্য উত্তরসূরিরা আজও নিষ্ঠার সঙ্গে তা বহন করে চলেছেন।
মানবাধিকার সুরক্ষা ও উন্নয়নে সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ
কামাল আহমেদ মজুমদারের প্রশ্নের জবাবে সংসদ নেতা বলেন, মানবাধিকার কমিশনকে শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে দেশের মানবাধিকার সুরক্ষা ও উন্নয়নে সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরই জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধিসহ পুনর্গঠন করে। ইতোমধ্যে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, যা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। সরকার ইতোমধ্যে কমিশনকে ৪৮ জন জনবল প্রদান করেছে।
আট বছরে ৪৬ লাখ কর্মী বিদেশে গেছেন : আয়েন উদ্দিনের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের দুই মেয়াদে (২০০৯ থেকে ২০১৭ সালের ১৫ জুন পর্যন্ত) মোট ৪৬ লাখ ৭৯ হাজার ২২৯ কর্মী বিদেশে গেছেন। তার সরকার বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাতকে থ্রাস্ট সেক্টর (অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত) হিসেবে ঘোষণা করেছে। এ খাতের গুরুত্ব বিবেচনায় সরকার বিদ্যমান শ্রমবাজার ধরে রাখার পাশাপাশি নতুন নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টিতে জোর দিয়েছে।
বিদেশে বাণিজ্য সম্প্রসারণে নানা উদ্যোগ
শফিকুল ইসলাম শিমুলের লিখিত প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদেশে বাণিজ্য সম্প্রসারণে আওয়ামী লীগ সরকার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন ও ভারতসহ ৪৫টি দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।