
শোকের পরিবারে ভাসিতেছি, জ্বলন্ত চিতা নিভবে কবে?
চন্দন কুমার আচার্য, সিরাজগঞ্জ: টাঙ্গাইল জেলার এলেঙ্গা পৌরসভাধীন হাকিমপুর গ্রামের ঢাকা বিভাগে তিন তন বার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক এলেঙ্গা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মনোরঞ্জন আচার্য ও প্রয়াত অনুপমা আচার্যীর মেঝ পুত্র কক্সবাজার থানার আনছার ব্যাটালিয়ান-১৫ এর সদস্য, পুলিশ সাব ইন্সপেক্টর প্রদীপ রঞ্জন আচার্য এর মেঝ ভ্রাতা ওয়াল্টন গ্রুপের কর্মরত প্রনব আচার্য (বিনয়) এর মেঝ দাদা প্রয়াত প্রনয় আচার্য গত বুধবার (২৬শে জুলাই-২০১৭ইং) সকাল ৮.০১মিনিটে ঢাকা বারডেম হাসপাতালে ইহজগতের মায়ামমতা ত্যাগ করিয়া পরলোক গমণ করেন। (দিব্যান লোকান স্বঃগচ্ছতুঃ)। মৃত্যু কালে তার বয়স হয়েছিল ৪২ বছর। মৃত্যৃকালে সে পিতা, ২ ভ্রাতা, স্ত্রী, ২ ভাই বৌ, ৩ ভাতিজি, ১ ভাতিজা সহ অসংখ্যা গুনগ্রাহী রেখে যান। সদ্য প্রয়াত কক্সবাজার থানার কর্মরত আনাছার ব্যাটালিয়ান-১৫ এর সদস্য প্রনয় আচার্যের মৃত্যুর সংবাদ শুনে হাকিমপুর, ভাবলা, চর ভাবলা, পাথাইলকান্দি ও এলেঙ্গা পৌরসভার সকল গ্রামের অসংখ্যা গুনগ্রাহী এবং পাবনা, কিশোরগঞ্জ জেলাম নেত্রকোনা জেলা, রাঙ্গামাটি জেলা ও রাজধানী ঢাকার তার রেখে যাওয়া অসংখ্যা গুনগ্রাহী তাকে এক নজর দেখার জন্য তার নিজ বাসভবন হাকিমপুর গ্রামের চলে আসেন এবং শোকাহত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
অনুভবে প্রণয় রঞ্জন আচার্য শৈশব-কৈশোর জীবন আত্মীয় স্বজনের ভিতর থেকে হারিয়ে যায় নি, পেছনে থেকে সারাক্ষণ স্মৃতি পুরনো বসত-ভিটার মতো কেবলি টানে। টানে আর বলে, যে যায় সে যায়, তাকে আর ফেরানো যায় না। এ টান, নাড়ির টান। এর মধ্যে ভালোবাসা ও অনুভবের যোগ্যসূত্র খুঁজে ফিরছি। ভাতিজা সঞ্জয় আচার্য্যর ফোন ২৬ জুলাই সকাল ৮.৩৯ মিনিটে। সঞ্জয় আচার্য্য’র ফোনটি শুনের বুঝে উঠলাম এটি একটি শোকাহত সংবাদ এ মুহূর্তে শ্রবণ ইন্দ্রিয়কে জানান দেবে। তাই সত্যি হলো। সঞ্জয় জানালো, ‘কাকা’ আর নেই। ভাই প্রনয় রঞ্জন আচার্য কারো কাছে কেবল প্রনয়। কারো কাছে আত্মা কাকা। ভাই-বোনের কাছে প্রনয় দাদা। ভাতিজির আত্মা কাকা ডাকটা আমাকে খুব মুগ্ধ করতো। এই ডাকের মাধুর্য এবং ব্যঞ্জনও অনেক। পরিবারের অকৃত্রিম বন্ধন সব পরিবারেই থাকে, আমার মনে হয়েছে প্রনয় রঞ্জন আচার্য এই পরিবারে ঐক্যের প্রতীকী চরিত্র। মামাতো ভাইয়েরাও তাকে সম্মান দিয়ে ডাকতো। বন্ধুদের কাছে প্রনয় নামেই পরিচিত ছিল বেশি। প্রনয় একজন সাধারণ মানুষ। কিন্তু পরিবারের কাছে, আত্মীয় স্বজনের কাছে ছিল অসাধারণ। স্ত্রী ও ভাতিজা ও ভাতিজিদের নিকট প্রিয় বন্ধনে রেখে, পিতা-ভাই সকলকে এই পৃথিবীতে রেখে যেতে যেতে হয়তো বলেছে, সকলকে একদিন যেতে হবে, আমি না হয় একটু আগে ভাগে চলে গেলাম। তোমরা মিলে মিশে থেকো,তাহলে আমি ভালো থাকবো। প্রনয় রঞ্জন আচার্য সহ তারা তিন ভাই। প্রনয় তার পরিবারে যেমন সবার কাছে আত্মা কাকা হিসাবে পরিচিত’ তেমনি ঐ পরিবারের সবার কাছে আমরা সকলেই তার কাছে ‘ বড় ভাই’ হিসেবে পরিচিত ছিলাম। প্রনয় রঞ্জন আচার্য সবার কাছে ছিল প্রিয়, সে ছিল বুদ্ধিমান। কিন্তু বিধির লিখন কি কখনও খন্ডান যায়।
প্রনয় আচার্য্য’র জীবনে তার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল, পরিবারের প্রতি, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু সহ সকলের প্রতি আত্মটান ও ভালবাসা ছিল অকৃত্রিম ও জ্বলজ্বলে। দীর্ঘদিন পর প্রনয় রঞ্জন আচার্য্য’র সাথে আমার দেখা হলে তার বড় ভাই হিসাবে দেখা হলেও আমি নিজেকে তেমন ভাবে উপস্থাপন করতে পারিন, মৃত্যুর প্রায় ১ মাস পূর্বে তার সাথে আমার দেখা হয়েছিল কথা হয়েছে। কারণ, তার কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ ছিল না। অনেকদিন পর দেখা হলেও সেই দেখা আমার শেষ দেখা। এইসব কারণে আমার কাছে বন্ধু বা ছোট ভাই হিসেবে প্রনয়বে খুব অসাধারণ মনে হয়েছে। পরিবারে অভিভাক হিসেবে, ভাই হিসেবে, ছোট ভাই হিসেবে প্রনয় আচার্য্য’র তুলনা হয় না। আবারও বলতে হয়, এ কথাই প্রনয় আমার কাছে অসাধারণ একজন সাধারণ মানুষ। প্রনয়ের অসুস্থতার পর পিতা এলেঙ্গা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (অবঃ) ফোনে বলতো, প্রনয় অবস্থা ভালো আছে কি না? প্রশ্ন আর প্রশ্ন। প্রনয়ের অকাল মৃত্যুকে দেখে বুকের ভেতরে হাহাকার ওঠে। বেলা শেষ হয়ে আসবে এভাবেই সকলের। নিভে যাবে জীবনের জলন্তদ্বীপ। চলে যেতে হবে আমার, আপনার সকলের। প্রনয় রঞ্জন আচার্য’র মতো আমাদের সকলকে একদিন জীবনের অন্তিম ঠিকানায় ফিরে যেতে হবে। তাই পরিবার বার বার বলে উঠছে প্রনয়, তোমার মৃত্যুতে আমরা সকলে শোকাহত। কেন বললে তোমার অন্তিম চিকিৎসার কথা? কেনই বা বললে না তোমার ব্রেইন সমস্যার কথা? তুমি বাগান সাজিয়ে গেলে, বাগানে ফুল ফুটবে, আকাশে চাঁদ উঠবে, পূর্ব দিগন্ত থেকে সূর্য উদয় হবে, তবুও খালি থেকে যাবে তোমার পরিবারের একখানা ঘর, একা থেকে যাবে তোমার বড় ভাই পুলিশ সাব ইন্সপেক্টর প্রদীপ আচার্য, ছোট প্রনব আচার্য, পিতা সাবেক প্রধান শিক্ষক মনোঞ্জন আচার্য, ভাতিজি তনুশী, রাজস্ত্রী, দেবু, জয়, তোমার আত্মীয় স্বজন এবং তোমার সহধর্মিনী দীপা আচার্যী। যে ধন-সম্পদ আজ সংসার জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছে, সে সম্পদ আর কোন ফিরে আসবে না এমন কি কারও কোন দিন ক্ষমতাও হবে না সম্পদ ফিয়ে দেওয়ার মতো।
তাই তার সহধর্মিনী স্ত্রী দীপা আচার্য স্বামীর জ্বলন্ত চিতা দেখে মনে অজান্তেই বলেছিল- আগুনের লেলিহান শিখা,জলন্ত নরক সম-পুড়েছে প্রিয়া সেথা পুড়েছে প্রিয়তম (অর্থাৎ আমার মন, প্রাণ)। অনেক স্বপ্নের মৃত্যুর মিছিলে, শোকাহত নারী-পুরুষ শিশু মেয়ে ছেলে। বিষাক্ত ধোঁওয়া ছড়ায়ে বাতাসে, যমদুত যেনো খেলিছে আকাশে। যেখানে ছিল প্রানের মেলা, কত কঁচি মুখ করিত যে খেলা। নিমতলীর সেই সব অভিশপ্ত ঘরে, স্মৃতিগুলি আজও তাই কেঁদে কেঁদে ফেরে। ঝরে গেলো কত প্রান, কতজন যে হবে, এমন মৃত্যু কোথাও কে দেখেছে কবে? নব বধু নয়া বর হাতের শংখ পড়েছে হাতে, কে জানিত রক্তের দাগে মুছে যাবে রাতে। স্বজনের পোড়া লাশ ভরে গেছে চারি পাশ, বাসরের ফুলে আর ছড়ায় না সুবাস। চারিদিকে হাহাকার-সারি বাঁধা অগ্নি চিতা, শোকার্ত মানুষের দল বেঁধেছে বহর। কারো প্রিয় ছোট বোন কারো বড় ভাই, আত্মীয় স্বজন সহ মা পরিজন কেও বেঁচে নাই। কাঁদিছে স্বজনেরা কাঁদিছে সারা দেশ, নির্মম মরনের সেথা কাটেনি তো রেশ। স্বজন পোড়ানো আগুন চিতার সমান, গড়েছে বাসর সেথা আজ দুটি ভাই। নিয়তির দোলাচলে এ জীবন দুলে চলে, হাসতে হবে তাই কান্না কে ভুলে। যে চিতা জ্বলছে বুকে-পোড়াবে সে ধুঁকে ধুঁকে, তবু-সাজবে বাসর, সাজাতে হবে নতুন রূপে।