
জাগ্রতবাংলা, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) : কলাপাড়া পৌর শহরের মুসলিমপাড়ায় স্বামী আর দুই সন্তান নিয়ে থাকেন নাসরিন জাহান। মাসুম শিকদারের স্ত্রী চার দেয়ালের গণ্ডির মধ্যে যার নিরিবিলি জীবনযাপন করার কথা তিনি এখন রীতিমত একজন নারী উদ্যোক্তার দায়িত্ব পালন করছেন। সচ্ছল পরিবারের মেয়ে, বিয়েও সচ্ছল পরিবারেই হয়েছে। চাইলেই তিনি শুয়ে-বসে আয়েশি জীবন কাটাতে পারতেন। কিন্তু সেটা না করে নিজে কিছু করতে চেয়েছেন সব সময়। পরিবারের কাজ শেষ করার পর অলস সময় কাটাতেন। তাই নিজে কিছু করার জন্য ভাবতে থাকেন। এমন সময় মাথায় আসে, গ্রামের বাড়িতে প্রচুর জায়গা পড়ে আছে। একটি অংশে একটি সবজির বাগান করা যেতে পারে। কৃষি উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখায় ২০১৩ সালে ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার’ পেয়েছেন এই উদ্যমী নারী। ২০২১ সালে প্রাণিসম্পদ প্রদর্শনীতে গবাদিপশু পালনে উপজেলা পর্যায়ে প্রথম হন নাসরিন জাহান। ২০২০ সালেও একইভাবে সেরার পুরস্কার অর্জন করেন। এ ছাড়া বাছুর পালনে ২০১৮ সালে পটুয়াখালী জেলায় তিনি শ্রেষ্ঠ খামারির স্বীকৃতি পান। ২০১৩ সালে ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার’ পেয়েছেন এই উদ্যমী নারী। মূলত: গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে গতি আনতে এ নারী কৃষি উদ্যোক্তাদের ভূমিকাই মুখ্য।
তথ্য সূত্রে জানা যায়, নিজের ইচ্ছের কথা স্বামীর কাছে তুলে ধরেন নাসরিন জাহান এবং উৎসাহ পেয়ে ধুলাসার ইউনিয়নে মুসলিমপাড়া এলাকা নিজের জমিতে শুরু করেন বিভিন্ন প্রকারের সবজি আবাদ শুরু করেন। বরবটি, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, শালগম, কাচাঁমরিচ, টমোটো, বুম্বাই মরিচ আবাদ করে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছে। এরপর পাশাপাশি চলছে ভুট্রা, সূর্যমুখি, মুগডাল। নিবিড় সবজি চাষ ও গাভীর খামার করে এলাকার নারীদের কৃষিকাজে উদ্বুদ্ধ করেছেন। বর্তমানে ১৫০ শতাংশ জমিতে চলছে সবজির আবাদ। নাসরিন জাহান নিজের প্রাইভেট ব্রাইট স্টার
প্রিকেডেট স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। হঠাৎ করে মহামারি করোনা ভাইরাসের কারনে ২০২০ সালে নিজের প্রাইভেট ব্রাইট স্টার প্রিকেডেট স্কুল বন্ধ থাকায় সময় নস্ট না করে এ সবজি চাষ শুরু করেন।
ধুলাসার ইউনিয়নে মুসলিমপাড়া গ্রামে কৃষি ক্ষেত্রে একজন সফল নারী নাসরিন জাহান। তারপর তিনি ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য দৃঢ প্রত্যয়ে নিজ জায়গার কিছু অংশে সবজি আবাদ শুরু করেন। মাত্র ত্রিশ হাজার টাকা খরচ করে সবজি চাষ শুরু করেন। এখন প্রতি বছর সবজি চাষ লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করেন নাসরিন জাহান। বাঁচতে হলে সৎপথে লড়তে হবে। শুরু হলো নাসরিন জাহানের জীবন-সংগ্রাম করে বাঁচতে হবে। সংসারের খরচ-খরচা বাদে সামান্য অর্থ হাতে জমা হয়। নাসরিন জাহান দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে নিজের স্বপ্ন-লক্ষ্য বাস্তবায়নে এগিয়ে যেতে
লাগলেন। রয়েছে কর্মচারি তাদের দ্বারা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা হয় এ সবজি গুলো। পৌর শহরে বাড়ীতে ভালো জাতের তিনটি গরু কিনে বাড়ির এক পাশে গবাদিপশু পালনের জন্য একটা খামার গড়ে তুললেন তিনি, নাম ‘নাসরিন ডেইরি ফার্ম’। সেটা ২০০৮ সালের কথা। বর্তমানে নাসরিনের ফার্মে ছোট-বড় মিলিয়ে ৪৫টি গরু আছে। মূলধন দেড় কোটি টাকা। গবাদিপশু পালন করে বিক্রি করেন তিনি। পাইকারি দরে স্থানীয় বাজারে দুধও বিক্রি করেন।
বুধবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নাসরিন জাহানের ফার্মে প্রতিদিন এখন ২০০-৪০০ লিটার দুধ উৎ্পাদিত হয়। কোনো কোনো সময় ৩০০-৪০০ লিটার পর্যন্ত পৌঁছায়। দুধ সংগ্রহ, দুধ থেকে ক্রিম আলাদা করা ও মাঠা তৈরির কাজ স্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ মেশিনের মাধ্যমে করা হয়। দুধ সংগ্রহ করার সময় নিজে উপস্থিত থেকে সব তদারক করেন নাসরিন। জানালেন, দুজন কর্মচারীও আছে। তাঁদের বেতনসহ সব মিলিয়ে প্রতি মাসে তাঁর খরচ প্রায় আড়াই লাখ টাকা। এত দুধ স্থানীয় বাজারে বিক্রি করা কঠিন। কাছের মানুষদের বিনা মূল্যে দিয়েও অনেক দুধ নষ্ট হয়ে যেত। তখন একটি মিষ্টির দোকান দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। কুয়াকাটা পর্যটন এলাকায় মিষ্টির দোকানটি খোলেন। তখন যোগাযোগব্যবস্থা ভালো না থাকায় কলাপাড়া থেকে মিষ্টি তৈরি করে কুয়াকাটায় নিয়ে বাজারজাত করা কঠিন ছিল। এ কারণে কুয়াকাটার দোকানটি কলাপাড়া শহরে নিয়ে আসেন। মিষ্টি মেলা নামে তাঁর দোকানটি এখন শহরের অভিজাত এক মিষ্টির দোকান হিসেবে পরিচিত। তাঁর দোকানে রসগোল্লা, কাঁচাগোল্লা, কালোজাম, রসমালাই, ক্ষীরমালাই, বেবি সুইট, লাল চমচম, সাদা চমচম, তাসনি চপ, পাটিসাপটা ও ছানা পাওয়া যায়। এ ছাড়া মেলে দই আর ঘি। মিষ্টির এই দোকান দেওয়ার আগে ২০১৪ সালে তিনি একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে মিষ্টি তৈরির
প্রশিক্ষণ নেন। এখন তিনি অন্যদেরও মিষ্টি তৈরির প্রশিক্ষণ দেন। প্রতি মাসে তাঁর ফার্মে সাত-আট টন গরুর গোবর হয়। এসব গোবর স্থানীয়রা তাঁর ফার্ম থেকে সংগ্রহ করে কৃষিজমি, মাছের ঘের ও বাগানের জন্য নিয়ে যান। বিনিময়ে কোনো পয়সা নেন না তিনি। নিজেদের কৃষিজমির জমির উর্বরতা বাড়াতেও এসব গোবর ব্যবহার করেন নাসরিন জাহান। দুধ ও মিষ্টি মিলে প্রতি মাসে বিক্রি প্রায় আট লাখ টাকা। সব খরচ মিটিয়ে মাসে লাখ টাকা লাভ থাকে বলে জানালেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বরগুনা, পটুয়াখালী, কলাপাড়া ও মহিপুর এলাকার ১০-২০টি ডেইরি ফার্ম তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা ও পরিকল্পনায় গড়ে উঠেছে। আগের তুলনায় দেশে নারী-পুরুষের মধ্যকার ব্যবধান বা জেন্ডার গ্যাপ কমে আসছে। আয় উপার্জনক্ষম কাজে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে।
কলাপাড়া উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা গাজী মো. শাহআলম বলেন, দারুণ কাজ করে চলেছেন নাসরিন জাহান। তাঁর আগ্রহ দেখে আমরাও অনুপ্রণিত হয়েছি। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় আমরা তাঁকে পশুসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প থেকে প্রশিক্ষণ, পরামর্শ, প্রয়োজনীয় ঔষধসহ যাবতীয় সহায়তা দিচ্ছি। তাঁকে অনুকরণ করে এখন অনেকেই গবাদিপশু পালনে উৎ্সাহী হয়েছেন।
কলাপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এ আর এম সাইফুল্লাহ বলেন, নাসরিন জাহান পরিশ্রমি, ধৈর্য, অধ্যবসায়, সাহস ও মেধাকে কাজে লাগিয়ে সংগ্রাম করে সাহসিকতার মধ্য দিয়ে কৃষি খামার করে তিনি একজন সফল নারী কৃষি উদ্যোক্তা ও খামারি হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। কৃষি অফিস থেকে তাকে আমরা যতোটা সম্ভব পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি।