
“ বাঁধ এগুলো অপসারণ করে দুটি ব্রিজ নির্মাণ করা হলে বেঁচে যাবে আড়িয়াল খাঁ নদী “
মিয়া মোহাম্মদ ছিদ্দিক, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ) : কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে প্রবাহমান আড়িয়াল খাঁ নদীতে ২ কিলোমিটারের মধ্যে দুটি বাঁধ দিয়ে পানি প্রবাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ব্রিজের অভাবে মরে যাচ্ছে আড়িয়াল খাঁ নদী। চোখের সামনে প্রবাহমান নদী হত্যা চলমান থাকলেও নদী রক্ষায় নেই কোন উদ্যোগ। থানার সামনের বাঁধ ও চরনোয়াকন্দী খামখেয়ালী বাজার (রুস্তমের) বাঁধ এগুলো অপসারণ করে দুটি ব্রিজ নির্মাণ করা হলে বেঁচে যাবে আড়িয়াল খাঁ নদী।
এদিকে বাঁধের দু’পাশ দখল করে অবৈধবাবে গড়ে উঠেছে দোকানপাট। স্থাপনা তৈরি করা হলেও তাদেরকে প্রশাসনের বাঁধার মুখে পড়তে হচ্ছে না।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নদীর বুক দখল করে তৈরি করা হয়েছে পুকুর,পাকা স্থাপনাও। ফলে মানচিত্র থেকে মুছে যেতে পারে নদী। নোয়াকান্দী এলাকায় আধা কিমি নদী খনন করে আড়িয়াল খাঁকে পুরাতন পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীর সাথে যুক্ত করে দিলেই পানি প্রবাহ বাড়বে।
জানা যায়, আড়িয়াল খাঁ নদের উৎপত্তি কিশোরগঞ্জের পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে। সেখান থেকে একটি শাখা হয়ে কটিয়াদী সদরের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুলিয়ারচর পর্যন্ত গেছে। এক সময়ের প্রবল খরস্রোতা নদ আড়িয়াল খাঁ। যে নদ ছিল আশপাশের বহু এলাকার ব্যবসা বাণিজ্য প্রসারের মূল চালিকাশক্তি। মূল ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদ আড়িয়াল খাঁর বুকে বয়ে চলত শত শত যাত্রী ও পণ্যবাহী নৌকা। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার বাজারগুলোতে এক সময় পাটের ব্যবসা রমরমা ছিল এ নদকে ঘিরে। কিন্তু গত কয়েক দশকে উন্নয়নের নামে এই নদের বুক চিরে নির্মাণ করা হয়েছে একের পর এক বাঁধ। যার প্রভাবে একসময়ের খরস্রোতা আড়িয়াল খাঁ পরিণত হয়েছে বদ্ধ জলাশয়ে। কোথাও সামান্য জলাধার,কোথাও কিছু জলাবদ্ধতা আবার কোথাওবা কচুরিপানার জঞ্জালের চিহ্ন নিয়ে যেন মুমূর্ষুভাবে টিকে থাকার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে নদটি। নদটির মাত্র পাঁচ কিলোমিটার জায়গার মধ্যে দেওয়া হয়েছে পাঁচটি বাঁধ দেওয়ায় নদের পাঁচ কিলোমিটার জায়গা মরে গেছে । আর এসব বাঁধের ওপর গড়ে ওঠা রাস্তা দিয়ে চলছে বড় বড় যানবাহন যা ময়মনসিংহ,ভৈরব ও নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় আড়িয়াল খাঁ নদ দিয়ে নৌপথে যোগাযোগ ও মালামাল পরিবহন করা হতো। এ ছাড়া বাঁধের দুই পাশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য দোকানপাট ও স্থাপনা। নদের বুকে একের পর এক অবৈধ বাঁধ দেওয়া হলেও কোনো বাধা আসেনি স্থানীয় প্রশাসন বা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কাছ থেকে।
এলাকার প্রবীণ একাধিক বাসিন্দারা জানান,আড়িয়াল খাঁর বুকে প্রথম এক কিঃমিঃ বাঁধ নির্মাণ করা হয় আশির দশকে। এর দু’পাশে গড়ে উঠেছে বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনাও। এই বাঁধটির প্রায় দেড় কিলোমিটার পশ্চিমে নদের জালালপুর অংশের খামখেয়ালি বাজার এলাকায় আরও একটি বাঁধ নির্মাণ করা হয় ১০ থেকে ১২ বছর আগে। এরপর একে একে অন্য বাঁধগুলো নির্মাণ করা হয়। প্রথম চারটি বাঁধ কটিয়াদী সদরের সঙ্গে জালালপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন অংশকে যুক্ত করেছে। শেষেরটি লোহাজুড়ির দুটি অংশকে যুক্ত করেছে। এলাকাবাসীরা আরো বলেন,উন্নয়নের নামে সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধির উদ্যোগে এসব বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। বাস্তবে কার্যকর কোনো উন্নয়ন হয়নি,অথচ নদ মরে গেছে।
স্থানীয় ব্যক্তি কফিল উদ্দিন বলেন, ‘সরকার যেখানে নদী রক্ষায় কাজ করছে। সেখানে আমাদের এখানে নদী হত্যা করে বাঁধ দেওয়া হচ্ছে, রাস্তা করা হচ্ছে। সেতু করে দিলে তো অন্তত নদীটি বেঁচে যায়। জীববৈচিত্র ঠিক থাকে। পরিবেশ ভালো থাকে। প্রশাসনের কাছে দ্রুত বাঁধগুলো সরিয়ে ব্রিজ নির্মাণের দাবি জানাই।’
আড়িয়াল খা নদীর পাড়ের প্রবীনশিক্ষক জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘আড়িয়াল খাঁ নদের পানিপ্রবাহ ফেরাতে হবে। এতে যদি এই সড়ক ও দোকানপাট সরাতে হয়, তাহলে তাই করা উচিত। চলাচলের জন্য সেতু করা যেতে পারে, বাঁধ নয়।’
কটিয়াদীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জ্যোতিশ্বর পাল বলেন, এক থেকে দেড় বছর আগে নির্মিত সর্বশেষ বাঁধটি জেলা প্রশাসনের নির্দেশে অপসারণ করা হচ্ছে। আপাতত পানিপ্রবাহের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। পুরনো বাঁধগুলো অপসারণের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
কিশোরগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মতিউর রহমান বলেন,‘নদীর পানি প্রবাহ বন্ধ করে বাঁধ দেওয়ার বিষয়টি আমি অবগত। নদে বাঁধ দেওয়া বেআইনি। বাঁধ দেওয়ার সময় সংশ্লিষ্টরা পাউবোর মতামত নেয়নি। বিষয়টি খতিয়ে দেখে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম বলেন, নদ ও নদীতে বাঁধ দেওয়া কোনোভাবেই ঠিক নয়। ইতিমধ্যে এক থেকে দেড় বছর আগে নির্মিত সর্বশেষ বাঁধটি অপসারণে গত ৮ মার্চ থেকে কাজ শুরু হয়েছে। বাকিগুলোর ব্যাপারে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’