
মহারানা প্রতাপ সিংহ ছিলেন একজন হিন্দুবীর যোদ্ধা-সহনশীল নেতা
ইতিহাসের পাতা থেকে
হিন্দুবীর ক্ষত্রিয়চূড়ামণি মেবার কুলতিলক মহারানা প্রতাপ সিংহ ছিলেন একজন হিন্দুবীর যোদ্ধার।
বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান থেকে হিন্দুদের যতই অত্যাচার, লুটতরাজ, জোড় পূর্বক ধর্মান্তরিত করা হোক না কেন, হিন্দু বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কথা মনে পড়লেই, মনে পড়ে যায় তাদের কথা। দেশ আমার, জাতীয় আমার, যে দেশে আমি জন্ম গ্রহণ করেছি, সে দেশে যতই অনাচার অত্যাচার করা হোক না কেন, দেশ থেকে হিন্দু জাতী সত্বা আজ নিজ দেশ থেকে বিতারিত হবে না। হিন্দুদের যতই অনচার অত্যাচার করা হোক না কেন, ইতিহাস বার্তাকে অনাচার অত্যাচার করে থামিয়ে রাখতে পারবে না? এটা বাংলাদেশের হিন্দুদের প্রতিজ্ঞা। হিন্দুদের অনচার অত্যাচার করছে যারা তাদেরও একদিন এ ভাবেই অত্যাচারিত হবে? বিচারের কাঠগড়ায় দাড়াতে হবে তাদেরকেও। আজ হিন্দুদের জেগে উঠতে হবে, বাঁচতে হলে করতে হবে লড়াই। যেমনটি করেছিল হিন্দু বীরযোদ্ধা মহারানা প্রতাপ সিংহ। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু বীর যোদ্ধা মহারানা প্রতাপ সিংহকে এভাবেই বলেছেন-
“তোমার আসন শূন্য আজি, হে বীর পূর্ণ কর, ঐ যে দেখি বসুন্ধরা কাঁপল থরথর। বাজল তূর্য আকাশ পথে, সূর্য আসেন অগ্নিরথে, আকাশপথে, এই প্রভাতে দখিন হাতে বিজয়খড়্গ ধর। ধর্ম তোমার সহায়, তোমার সহায় বিশ্ববাণী। অমর বীর্য সহায় তোমার, সহায় বর্জ্রপাণি। দুর্গম পথ সগৌরবে, তোমার চরণচিহ্ন লবে, সগৌরবে। চিত্তে অভয় বর্ম, তোমার বক্ষে তাহাই পর।”
মহারাণা প্রতাপ ১৫৪০ সালের ৯ মে জন্ম গ্রহণ করে এবং ১৫৯৭ সালে ১৯ জানুয়ারী মৃত্যু বরণ করে। প্রতাপ ছিলেন মেওয়ারের শিশোদিয় রাজবংশের একজন হিন্দু রাজপুত রাজা। মেওয়ার উত্তর পশ্চিম ভারতের একটি প্রদেশ, বর্তমানে এই প্রদেশ রাজস্থান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। তিনি ছিলেন রাজপুতদের বীরত্ব ও দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক। বহু বছর ধরে তিনি মুঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গে লড়াই করেন। ১৫৭৬ সালে আকবর চিতোর দুর্গ আক্রমণ করেন। ১৫৭৮ সালে আকবরের কাছে মেবারের প্রধান দুর্গ চিতোরের পতন ঘটে। প্রায় ৪০০ বছর আগের ভারতবর্ষ, একের পর এক ভিনদেশী শাসক দখলদাররা বিশাল সৈন্যবাহিনী, অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে ভারতের বিভিন্ন অংশে আক্রমণ করে দখল করে নিচ্ছে ভূখণ্ড। তাদের মধ্যে আফগান, তুর্কী আর মুঘলরা তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণের জন্য রাজনৈতিক ও সেনাকৌশল প্রয়োগ করে সফল হয়েছে। তারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শাসন শুরু করেছে। সেই কঠিন সময়ে একটি রাজ্য বিদেশী শাসক আর আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল প্রতাপ। বিদেশী দখলদারদের রুখতে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করল তারা। রাজপুত প্রতাপের অধ্যুষিত মেবার অনেক ঐতিহাসিক নাটকীয় ঘটনার কেন্দ্র বিন্দু হয়ে আছে।
মুঘলদের প্রতিরোধে রাজপুতরা সর্বাত্মক শক্তি ও সমরকৌশল প্রয়োগ করেছিল। রাজপুতদের অসীম সাহস, মনোবল এবং নিপুণ যুদ্ধকৌশল মুঘলদের বার বার বিচলিত ও অস্থির করে তুলেছিল। তখন মেবার রাজ্য বিদেশী আক্রমণকারীদের প্রতিরোধে যে শক্তি, সাহস, মনোবল আর স্বদেশ প্রেমের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল তা আজও হিন্দুত্ববোধ এবং ইতিহাসকে উদ্দীপ্ত করে তুলেছে।
মুঘল সম্রাট আকবর বুঝতে পেরেছিলেন যে রাজপুতরা শত্র“ হিসাবে প্রবল, কিন্তু মিত্র হিসাবে নির্ভরযোগ্য। আকবরের শাসনকালে তিনি রাজপুতদের সাথে সন্ধি করার প্রয়াস করেছিলেন। কিছুটা যুদ্ধের দ্বারা এবং অনেকটা বিবাহ সূত্রে তিনি এই প্রয়াস সফল করেছিলেন। অম্বরের রাজা ভগবান দাস আকবরের সভার নবরতেœর একজন ছিলেন। ভগবন দাসের পুত্র রাজা মানসিংহ আকবরের সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি ছিলেন। রাজা টোডরম্ল ছিলেন আকবরের অর্থমন্ত্রী। আরেক রাজপুত বীরবল ছিলেন আকবরের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ও প্রিয়পাত্র।
বেশীরভাগ রাজপুত রাজ্য যখন আকবরের অধীনে চলে এসেছে তখন একমাত্র মেওয়ারের রাজপুত রাজা মহারাণা উদয় সিংহ মুঘলদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন। চিতোরের পতনের পর তিনি উদয়পুর থেকে মেওয়ার শাসন করতেন। তাঁর সুযোগ্য পুত্র মহারাণা প্রতাপ সিংহ সারা জীবন মুঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন। মেওয়ারের রাজপুতরাই একমাত্র রাজপুত যাদের আকবর তাঁর জীবদ্দশায় জয় করতে পারেননি।
মেবার রাজ্যের সেই ঐতিহাসিক ঘটনার নায়ক ছিলেন মহারাণা প্রতাপ, যিনি রাজপুতদের সংগঠিত করে বিদেশী মুঘল শাসকদের প্রতিরোধ করেছিলেন। বীর যোদ্ধা মহারাণা প্রতাপ সমগ্র ভারতবর্ষের মুক্তির লক্ষ্যে নতুন এক চেতনার জন্ম দিয়েছিলেন। মহারাণা প্রতাপ ছোটবেলা থেকেই সাহসী এবং স্বাধীনচেতা ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ পুত্র। সৎ মায়ের বিরূপ আচরণ সত্ত্বেও তাঁর প্রতি মহারাণা প্রতাপের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা ছিল অটুট, ভাইদের প্রতিও তাঁর দায়িত্ববোধ এবং ভালবাসা ছিল অসামান্য। সাধারণ মানুষের জন্য মহারাণা প্রতাপ ছিলেন একজন সহানুভূতিশীল দরদী নেতা। জনগণের পাশে তাদের সহায়তায় সব সময় তাঁর হাত বাড়ান থাকত। ভাইদের হিংসা বিদ্বেষের পরেও মহারাণা প্রতাপ তাঁদের মঙ্গল করেছেন। তাঁরা সম্রাট আকবরের তাঁবেদার হয়ে মহারাণা প্রতাপের অনেক ক্ষতি করলেও তিনি তাঁদের ক্ষতি করেননি। তাঁর মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে শেষ পর্যন্ত ভাইদের মনোভাব বদলে যায় এবং তাঁরা মহারাণা প্রতাপের পক্ষ নিয়ে মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন।
মুঘল সম্রাট আকবরের নামের সঙ্গে ‘দ্য গ্রেট’ (মহান) যুক্ত হলে, মেবারের রাজা রাণা প্রতাপের সঙ্গে কেন তা যুক্ত হবে না? মহারাণা (রাণা প্রতাপ) মেবার অঞ্চলে যে শৌর্য ও মহানুভবতার নজির রেখে গেছেন, তা কোন অংশে কম?
এই প্রসঙ্গে সকল ইতিহাসবিদদের প্রকৃত ইতিহাস উদ্ধারের আহ্বান জানান উচিৎ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে মহান হিসেবেই রাণাকে উপস্থাপন করা উচিৎ কিনা তা ভবিষ্যতই বলে দিবে।
সিকেএ / জাগ্রতবাংলা