
যমুনা-তিস্তা খেয়েছে ঘরবাড়ী-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : উত্তরবঙ্গে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত
চন্দন কুমার আচার্য, সিরাজগঞ্জ: যমুনা-তিস্তা খেয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-ঘড়বাড়ী। উত্তরবঙ্গে এলাকা প্লাবিত হয়েছে। খরায় ধু ধু চরের যমুনা নদী এখন বর্ষায় থইথই করছে। বন্যার পানিতে উত্তাল যমুনা তীরবর্তী সিরাজগঞ্জ জেলার কাজিপুর, বেলকুচি, চৌহালী, শাহজাদপুর এবং টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর, ভুয়াপুর থানার গোবিন্দদাসী, গোয়ালিয়া, দূর্গাপুর, সল্লা, এলেঙ্গা পৌর এলাকার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ফলে পানিবন্দি হয়ে লাখো মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছে।
মঙ্গলবার সিরাজগঞ্জ জেলার কাজিপুর, বেলকুচি, চৌহালী, এনায়েতপুর, টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর হার্ড পয়েন্টে নদীর পানি বিপদসীমার ৩২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে নিম্ন অঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। অপরদিকে বুধবার সকাল থেকে বঙ্গোপসাগরের লঘু চাপের কারণে উত্তরবঙ্গে অবিরাম বৃষ্টিপাত হচ্ছে, মানুষ হয়েছে ঘরবন্দী। গবাদীপশু নিয়ে পড়েছে চরাঞ্চলের মানুষ পড়েছে বিপাকে।
সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় চরাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। প্রতিদিন জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। চৌহালী উপজেলায় পূর্বেই ৮২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিলিন হয়ে গিয়েছে। নতুনা করে আরও ৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং জেলায় সর্বমোট ৪৫টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, যমুনার পানি ক্রমাগত বাড়তে থাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ওপর চাপ বাড়ছে। ১০৯ যমুনা নদীর তীর সংরক্ষণ প্রকল্প এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে।
শাহজাদপুরে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। বন্যার কারণে কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে পড়ায় বন্ধ রয়েছে পাঠদান। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ার কারণে ২শ বাড়ি ঘর ভেঙ্গে গিয়ে মানুষ হয়েছে দিশেহারা। শাহজাদপুর ও চৌহালীতে বন্যা পরিস্থিতির কারণে অনেকই ওয়াপদা বাঁধ এবং আত্মীয় স্বজনের বাড়ি এবং শাহজাদপুর পৌর এলাকায় ৫ শতাধিক পরিবার সেখানেই অবস্থান করছে।
বন্যা কবলিত এলাকায় ত্রান বিতরণ শুরু করেছে। গতকাল সোমবার শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরী ইউনিয়নের হাটপাচিল পূর্বপাড়া, সোনাতুনি ইউনিয়নের শ্রীপুর ও ধীতপুর গ্রামে যমুনা নদীর ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্ত ২ শতাধিক পরিবারকে নগদ ২০০ টাকা করে বিতরণ করা হয়েছে। হাটপাচিল পূর্বপাড়া গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত গোলেজা খাতুন,জিরাখাতুন, হাফিজা খাতুন, এনতাজ শেখ, কেরামত ব্যাপারী, জহুরা খাতুন, বিলকিস, হাওয়া খাতুন, ভানু খাতুন তাৎক্ষণিক এ সাহায্য পেয়ে খুশিতে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তারা জানান, এ সাহায্য তাদের বেচে থাকার একটু অবলম্বন। তবে তারা স্থায়ী ভাবে তাদের পূণঃবাসনের জোর দাবী জানিয়েছেন।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগ সূত্রে জানা যায়, উত্তরবঙ্গের রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়ার সারিয়াকান্দি, লালমনিহাটের বেশ কয়েকটি উপজেলার প্রায় ৪ শতাধিক পরিবার পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবন যাপন করছে। তিস্তার পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নদী তীরবর্তী বিভিন্ন এলাকা ও চরাঞ্চলে পানি ঢুকে পড়ে। এতে অন্তত ৭ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে।
তিস্তাপাড়ের গঙ্গাচড়ার নোহালী ইউনিয়নের ফোটামারী, চরনোহালী, মিনার বাজার, চরবাগডোহরা ও নোহালী সাপমারী, কোলকোন্দ ইউনিয়নের চিলাখাল, মটুকপুর, বিনবিনা ও সাউদপাড়া, গঙ্গাচড়া সদর ইউনিয়নের ধামুর ও গান্নারপাড়, লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের শংকরদহ, পূর্ব ইচলী, জয়রামওঝা ও পশ্চিম ইচলী, গজঘণ্টা ইউনিয়নের ছালাপাক, গাউছিয়া বাজার, রমাকান্ত, মহিষাশুর, কালীর চর ও রাজবল্লভ, আলমবিদিতর ইউনিয়নের ব্যাঙপাড়া ও হাজিপাড়া এবং মর্ণেয়া ইউনিয়নের নিলারপাড়া, চরমর্নেয়া, আলাল চর, চরমৌভাষা ও নরসিং এলাকা তলিয়ে গেছে। এসব এলাকার হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
নীলফামারীতে উজানের ঢলে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার ৩৫ গ্রামের ১০ সহস্রাধিক মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। ডিমলার পূর্ব ছাতনাই, খগাখড়িবাড়ী, টেপাখড়িবাড়ী, খালিশাচাপানী, ঝুনাগাছচাপানী, গয়াবাড়ী ও জলঢাকা উপজেলার, গোলমুন্ডা, ডাউয়াবাড়ী, শৌলমারী ও কৈমারী ইউনিয়নের নদীতীরবর্তী ৩৩ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব গ্রামের ১২ সহস্রাধিক মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে অন্তত ৮ সহস্রাধিক পানিবন্দি রয়েছে।
গাইবান্ধার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির সোমবার আরো অবনতি হয়েছে। শহরের পাশের এলাকায় বন্যার পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে। সুন্দরগঞ্জ, সদর, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। চার উপজেলার প্রায় ৫৫ হাজার পরিবার এখন পানিবন্দি। পানির তোড়ে সদর উপজেলার কামারজানি বন্দরের দক্ষিণ দিকে ভাঙন শুরু হয়েছে।
সিরাজগঞ্জের যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বাঁধের অভ্যন্তর এবং চরাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা পাবিত হচ্ছে। সদর উপজেলার খোকশাবাড়ী এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে পানি ঢুকে রানীগ্রাম, গুনেরগাতী ও খোকশাবাড়ী এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
বগুড়ায় যমুনার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। অব্যাহত পানি বৃদ্ধির ফলে সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীর তীর সংরক্ষণ প্রকল্প এলাকায় ভাঙণ দেখা দিয়েছে। বয়রাকান্দি, ধলিরকান্দি ও বড়ইকান্দি গ্রামের লোকজন আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে।
সিরাজগঞ্জ জেলার কাজিপুরে ৩নং স্পারে ধ্বস ২০০ মিটার নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে। জানা যায়, উজান থেকে বয়ে আসা বন্যায় কাজিপুর উপজেলার মাছুয়াকান্দি গ্রামের ৩নং স্পারে আকর্ষিক ধ্বস নামে। রবিবার সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত স্পারের ২০০ মিটার বিলীন হয়ে যায়। এতে স্পার এলাকার কমপক্ষে ১০টি পরিবার ঘর-বাড়ি আকর্ষিকভাবে সরিয়ে নিয়ে সক্ষম হয়। এর মধ্যে কিছু পরিবারের আসবাবপত্র ও ঘরের বেড়া পানির স্রোতে ভেসে যায় বলে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার সুত্রে জানা যায়। ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলো হলো মাছুয়াকান্দি গ্রামের শফি, রাজ্জাক, আলামিন, শামছু, শফি, বক্কর, আজিবার, ফজল ও আবুল হোসেন। এরা রবিবার রাত ১২টায় স্থানীয় মসজিদের মাইক থেকে স্পারের আকর্ষিক ধ্বসের খবর জানিয়ে দেন এবং লোকজন সমবেত করে ঘর-বাড়ি সরিয়ে নিতে ভাঙ্গন কবলিত এলাকাবাসীরা সহযোগিতা চান। আকস্মিক স্পার ধ্বসের ফলে ভাটি এলাকার কয়েক গ্রামের মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ভাঙ্গনের সংবাদ শুনে কাজিপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ শফিকুল ইসলাম বিকালে ঘটনার স্থলে গিয়ে পরিদর্শন করেন। ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সাথে তিনি কথা বলেন। তাদেরকে সহযোগিতার আশ্বাস দেন এবং ভাঙ্গন রোধে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে নির্দেশ দেন।