
শাহজাদপুরের অপরূপ লীলা ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ‘রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ’র ক্যাম্পাস
চন্দন কুমার আচার্য, সিরাজগঞ্জ : নৈসর্গীক সৌন্দর্য্যরে এক অপরূপ লীলা ভূমি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বুড়িপোতাজিয়া মৌজার বাথান এলাকার কুঠিরভিটা। বৃটিশ আমলে নীলকর সাহেবদের নীল চাষ তদারকির নীলকুঠি ছিল এখানে। ইতিহাস খ্যাত এই স্থান সহ এর পাশের রাউতগাড়ি, রামকান্তপুর ও হান্নি মৌজায় রয়েছে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জমিদারির ৩ হাজার একর নিজস্ব জমি। এ জমির উপরেই প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে দেশের ৩৮ তম পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ‘রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ’।
শাহজাদপুরের এই নৈসর্গীক সৌন্দর্য্যরে লীলা ভূমির সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বার বার এই শাহজাদপুরে ছুটে আসতেন। তার বহু লেখায় তিনি এ প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। তার ছিন্নপত্রে তিনি লিখেছেন, আমি এখানে এলে এক ধরণের আলাদা প্রশান্তি অনুভব করি, যা অন্য কোথাও পাই না। তিনি শিলাইদহ থেকে বোটে করে শাহজাদপুরের কাছারি বাড়িতে আসা যাওয়ার পথে এই বাথান এলাকা অতিক্রমের সময় এর সৌন্দর্য্য প্রাণ ভরে উপভোগ করতেন এরং মুগ্ধ হতেন।
বড়াল, গোহালা,ধলাই,সোনাই,চিকনাই ও বলেশ্বরী নদী বেষ্টিত এ এলাকার জেলেদের জীবিকা নিশ্চিত করতে তিনি জাল যার জলা তার প্রথা চালু করেন। আবার এ এলাকার কৃষকের উন্নয়নে তিনি সিন্ধু প্রদেশ থেকে সিন্ধি জাতের উন্নত গাভী এনে দিয়ে ছিলেন। শুধু তাই নয় এ সব উন্নত জাতের গবাদি পশুর খাদ্য নিশ্চিত করতে নিজ জমিদারির লাখেরাজ জমির খাজনা মৌকুফ করে বিশাল এলাকায় গড়ে তুলে ছিলেন গোচারণ ভূমি। যা আজও বিদ্যমান।
ফলে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহযোগীতায় আজ শাহজাদপুর সহ এর আশপাশ এলাকা দুগ্ধ অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু এ অঞ্চলের কৃষকদের উৎপাদিত দুধ বাজারজাত করতে এ এলাকার বাঘাবাড়িতে কৃষকদের নিয়ে সমবায়ী প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটা কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন।
মাঠ ভরা গরুর পাল,দিগন্ত জোরা শষ্য,রাখালের বাঁশির মধুর সুর,জেলেদের মৎস্য আহরণের কলতান, পাল তোলা নৌকায় নায়রী যাত্রা, মাঝির ভাটিয়ালি গান, কামারের ঠুংঠাং আওয়াজ, কুমারের হাকডাক, গাঁয়ের কৃষাণি বধূর নদী থেকে জল তুলে কলসী কাখে ঘরে ফেরা,মাছরাঙা,গাংচিল,পানকৌরির জলকেলি,ডাহুকের ডাক,শালিকের কিচিরমিচির, বকের ঝাঁকের উড়ে চলা,শিয়ালের হুককা হুয়া ডাক,গোচারণ ভূমিতে গরুর পালের হামবা হামবা ডাক,বাতাসে সোনালী ধানের দোলা,পরন্ত বিকেলে নদীর ঢেউয়ের সাথে সোনা রোদের ঝিকিমিকি জলকেলি, ভরা পূর্ণীমায় জ্যোৎনায় অবগাহণ রবি কবিকে আকৃষ্ট করত। তাই বার বার তিনি শাহজাদপুরে ছুটে এসেছেন। উপভোগ করেছেন এ অঞ্চলের নৈসর্গীক সৌন্দর্য্য। তার বহু লেখায় এর উল্লেখ রয়েছে।
কবির সেই মন মুগ্ধকর স্মৃতিকে শ্রোদ্ধা ভরে স্মরণ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই স্মৃতি চির অমর করে ধরে রাখতে শাহজাদপুরে কবির প্রিয় সেই গোচারণ ভূমি এলাকায় তার জমিদারির নিজস্ব জমিতে তার নামে বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেন। এ বিশ^বিদ্যালয়ের নাম করণ করা হয় রবীন্দ্র বিশ্ব বিদ্যালয় বাংলাদেশ। যা চলতি সেশন থেকে ক্লাস শুরুর মধ্য দিয়ে বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের যৌথ প্রয়াস ও অর্থায়নে এটি বাস্তবায়ন হবে।
ইতিমধ্যেই মহামান্য রাষ্ট্রপতি রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগ চুড়ান্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছেন। তাই শাহজাদপুরের সর্বত্র বৈছে আনন্দের বন্যা। মিছিল মিটিং মিষ্টি বিতরণ ও উৎসব আমেজে ভাসছে গোটা শাহজাদপুর।
অপর দিকে বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ স্থানে যেতে চলছে রাস্তা নির্মাণ সহ প্রাথমিক নানা কাজ। ইতিমধ্যেই রাউতারা সড়কের পোতাজিয়া কবরস্থান থেকে বাথান এলাকা পর্যন্ত ২ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ ও পাঁকা করণের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। আগামী ১ সপ্তাহের মধ্যে এ কাজ শেষ হবে বলে জানা গেছে।
ভিসির আবাসস্থল, প্রশাসনিক ও একাডিমিক ভবনও প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে শাহজাদপুর উপজেলার বিসিক বাসস্ট্যান্ডে অবস্থিত সুইটড্রিম হোটেলকে প্রশাসনিক ভবন,শাহজাদপুর সরকারী কলেজের ড.মযহারুল ইসলাম বিজ্ঞান ভবন,বঙ্গবন্ধু মহিলা কলেজ,হযরত মখদুম শাহদৌলা(রঃ) ডিগ্রি কলেজ ও শাহজাদপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজ ও শাহজাদপুর মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের নব নির্মিত ভবনকে ক্লাসের জন্য একাডেমিক ভবন হিসাবে অস্থায়ী ভাবে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।
ইতিমধ্যেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এ ব্যাপারে লিখিত অনুমতি নিয়ে সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
শাহজাদপুর উপজেলা চেয়ারম্যান প্রফেসর আজাদ রহমান ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার আলীমুন রাজীব এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তারা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক পত্রের প্রেক্ষিতে সিরাজগঞ্জের জেলা প্রসাশক থেকে এ সংক্রান্ত তথ্যাদি চেয়ে পাঠালে তা দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা নিয়ে প্রস্তাব পত্রটি পাঠানো হয়েছে। তারা আরো জানান, চলতি সেশনেই শাহজাদপুরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু হবে। ইতিমধ্যেই ভিসি নিয়োগ চুড়ান্ত করা হয়েছে। তাই দ্রুত গতিতে এর সকল প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এ ছাড়া এ বিশ^বিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ স্থান বাথান ভূমির কুঠিরভিটা এলাকায় যেতে কাঁচা সড়ক পাঁকা করণের কাজ প্রায় শেষের পথে। পিডি নিয়োগ হলেই এখানে মাটি ভরাট ও অবকাঠাম নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে যাবে। এ ছাড়া খুব সহসাই শিক্ষক ও অন্যান্য পদে লোকবলও নিয়োগ দেয়া হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়াদী শুরু করা হয়েছে।
এ দিকে চলতি সেশনেই ক্লাস চালুর খবরে শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ,পাবনা,নাটোর,বগুড়া সহ উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার ছাত্র-অভিভাবকদের মধ্যে আনন্দের বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ার বইতে শুরু করেছে।
এ দিকে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রবীন্দ্র বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাস্থল পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে রাউতারা স্লুইচ গেট সংলগ্ন রিং বাঁধ দিয়ে জমাদ্দারের বাথান,ডওরবাড়ি বাথান,ছোটঝাঁড়ের বাথান,বুড়িরভিটা, কুঠিরভিটা,ছোটভিটা সহ অর্ধশত গোচারণ ভূমি এলাকা দিনভর সরেজমিনে পরিদর্শন করলাম। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, এখানকার সব গুলো নদী বর্ষার পানিতে টুইটুম্বর হয়ে গেছে। দল বেঁধে গরুর পাল মাঠে চরে বেড়াচ্ছে আর সবুজ কাঁচা ঘাস খাচ্ছে। রোদেলা দুপুরে গামছা অথবা ছাতা মাথায় দিয়ে রাখালের দল বসে গরু পাল পাহাড়া দিচ্ছে। দূরে রাখালিয়া বাঁশির সুর, জেলেদের মাছ ধরার কলতান,শালিকের কিচিরমিচির,মাছরাঙ্গা,গাংচিল,পানকৌড়ির জলকেলি আর বকের ঝাকের উড়ে চলার দৃশ্য কবির সেই স্মৃতিময় অপরূপ নৈসর্গীক সৌন্দর্য্যরে লীলা ভূমির কথা মনে করিয়ে দেয়। মূহুর্তে শীতল হয়ে যায় মন প্রাণ।
পথে কথা হল বাথান এলাকার কৃষাণ ও রাখাল সুরুজ মিয়া, সাগর মিয়া, আল মামুন,সাদ্দাম, তারিকুল, জোচন, আলমগীর, আফাজ, সাত্তার, রুবেল, শাহিন, কালাম, সামাদ, জব্বার, মন্টু, শাহন ও সোহেলের সাথে। তারা জানালেন,এই বাথান ভূমিতে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ায় তারা মহা খুশি ও আনন্দিত। স্বল্প খরচে বাড়ির ভাত খেয়ে তাদের সন্তানেরা বিবিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবে। এটা তাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া। যা তারা কখনো স্বপ্নেও ধারণা করতে পারেননি। আজ তা বাস্তবে পরিণত হওয়ায় তারা মহা খুশি ও আনন্দিত। ফলে পুরো বাথান এলাকার মানুষ রবীন্দ্র বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার খবরে আনন্দেন জোয়ারে ভাসছে। তারা অপেক্ষার প্রহর গুণছে,কবে চালু হবে এর পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম।