
শ্রীজগন্নাথদেবের কাঁঠাল চুরির অপূর্ব লীলা কাহিনী
চন্দন কুমার আচার্য, সিরাজগঞ্জ: শ্রীজগন্নাথদেব তাঁর মহান ভক্ত রঘুর সাথে প্রায়ই দেখা দিতেন এবং নানান লীলা করতেন। রঘুর সাথে তিনি বন্ধুর মত মিশতেন ও লীলা করতেন। একবার শ্রীজগন্নাথদেব তাঁর মহান ভক্ত রঘুর কাছে এলেন এবং তাঁকে রাজার বাগান থেকে কাঁঠাল চুরি করতে তাঁরা সাথে যেতে বললেন। রঘু বলল, “তুমি কেন কাঁঠাল চুরি করতে চাও? তোমার যদি কাঁঠাল খাবার ইচ্ছা হয়, আমাকে বল-আমি তোমার জন্য সুন্দর একটি কাঁঠাল এনে দেব”।
বালকরূপী জগন্নাথ বললেন, “এইভাবেই আমি আমার ভক্তের কাছ থেকে সবকিছু নিয়ে থাকি। বস্তুত, আমার সবকিছুই আছে। মা যশোদা আমাকে কত ননী-মাখন খাওয়াতো, আমাকে আনন্দ দিত; কিন্তু তবুও আমি অন্যদের বাড়ীতে মাখন চুরি করতে যেতাম। চুরি করা দ্রব্য ভোজনে বিশেষ আনন্দ আছে। আজ তোমাকে আমি উপলব্ধি করাব-চুরি করা কি আনন্দের! আমার সঙ্গে এসো”।
নিরুপায় হয়ে রঘু জগন্নাথদেবের প্রস্তাবে সম্মত হল এবং তাঁর সঙ্গ নিল। তাঁরা উভয়ে চুপিসারে রাজার বাগানে প্রবেশ করলেন। জগন্নাথ রঘুকে বললেন, “তুমি গাছে চড়বে, আমি মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকবো। তুমি সবচেয়ে সুন্দর ও বড় কাঁঠালটি পাড়বে এবং মাটিতে ফেলবে। আমি এখানে দাঁড়িয়ে ধরবো। তারপর আমরা উভয়ে কাঁঠাল নিয়ে পালাব”।
রঘু যথাযথভাবে প্রভুর নির্দেশ অনুসরণ করে গাছে উঠে সবচেয়ে বড় ও ভাল কাঁঠালটি খুঁজে বের করল এবং সেটা পাড়ল। “জগন্নাথদেব” রঘু চাপাস্বরে জগন্নাথকে ডাকল। “তুমি কি তৈরি?” জগন্নাথ উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ, আমি তৈরি, নিচে ফেল”॥
রঘু কাঁঠাল নিচে ফেলল-জগন্নাথ সেটা ধরবেন ভেবে। কিন্তু কোথায় জগন্নাথ? তিনি ইতিমধ্যেই বাগান থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। কাঁঠাল ধরার মত সেখানে কেউই ছিল না। সশব্দে কাঁঠালটি মাটিতে পড়ে ফেটে চৌচির হল। যখন রাজার বাগানের মালী ঐ শব্দ শুনল, সে বুঝতে পারল যে কেউ বাগানে ঢুকে কাঁঠাল চুরি করছে। তৎক্ষণাৎ সে দৌড়ে গাছটির কাছে গেল এবং একটি বড় কাঁঠাল ফেটে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখল।
“রঘু এখনও গাছের মাথায় বসে রয়েছে!” মালী উত্তেজিত স্বরে রাজাকে বলল। রাজা বিশ্বাস করতে পারলেন না যে রঘু তাঁর বাগানে গিয়ে কাঁঠাল চুরি করবে। সুতরাং রাজা তাঁর মন্ত্রীদের সাথে নিয়ে মালীর নির্দেশিত স্থানে গেলেন। তিনি রঘু দাসকে গাছে চড়ে থাকতে এবং নীচে কাঁঠাল পড়ে থাকতে দেখে আশ্চর্য হলেন।
রাজার অনুরোধে রঘু গাছ থেকে নেমে এল। রাজা রঘুকে জিজ্ঞাসা করলেন, “প্রভু, তোমার যদি কাঁঠাল খাওয়ার ইচ্ছে হয়ে থাকে, তাহলে গভীর রাতে আমার বাগানে এসে গাছে চড়ার কি প্রয়োজন ছিল? তুমি আমাকে একবার বলতে পারতে? আমি কাঁঠাল পাড়ার ব্যবস্থা করে তোমার বাড়ীতে পাঠিয়ে দিতাম।”
রঘু তখন প্রভু জগন্নাথ কিভাবে তাঁকে ঠকিয়েছে-সব বৃত্তান্ত খুলে বলে। প্রত্যেকেই প্রভুর রম্য এই লীলা শুনে খুব আনন্দ পেল এবং সকলেই হাসতে লাগল। তাঁরা রঘুর মহত্ত্বের জন্য তাঁর গুণগান করলেন। এইভাবে সখ্য রসে প্রভু জগন্নাথ রঘু সঙ্গে অনেক লীলা করেছিলেন।
একজন ভক্ত রঘু দাসের সঙ্গে শ্রীজগন্নাথের লীলার একটি প্রত্যক্ষ বর্ণনা দিয়েছেন। একবার রথযাত্রার সময় জগন্নাথ-বলদেব-সুভদ্রা তাঁদের নিজ নিজ রথে আরোহণ করে আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। রাজা এসে পথ সম্মার্জন করেছেন এবং রথ তখন চলার জন্য তৈরি। হাজার হাজার মানুষ রথের দড়ি টানতে লাগল, কিন্তু রথ টানতেই পারল না। পরিস্থিতি দেখে একজন ব্রিটিশ সাহেব রথ টানার জন্য শক্তিশালী হাতির ব্যবস্থা করলেন। তবুও রথ অনড়। সাহেব রঘু দাসকে বললেন, “রঘু দাসজী, এ কেমন ভগবান? আমি হাতিদেরও নিয়োগ করেছি, তবুও রথ চলছে না।”
একথা শুনে রঘু রথে উঠল এবং শ্রীজগন্নাথের কাছে গেল। সে জগন্নাথের কানে কানে কিছু বলল। তৎক্ষণাৎ রথ চলতে শুরু করল। সাহেব এটি দেখে বিস্মিত হলেন। তিনি রঘু দাসকে বললেন, “তুমি অপূর্ব, তোমার প্রভুও অপূর্ব।”
রঘু দাস যেখানেই থাকত, সেখানেই সে একপাত্র প্রসাদ বাইরে রেখে দিত যাতে যে কেউ সেখান থেকে প্রসাদ পেতে পারে। পশুপাখিরা ঐ পাত্র থেকে প্রসাদ গ্রহণ করত, ঐ একই পাত্র থেকে রঘুও প্রসাদ গ্রহণ করত। তাঁর ছিল এমনিই অপূর্ব স্বভাব। রঘু ছিল শ্রীজগন্নাথের অত্যন্ত প্রিয় সখ। জয় পরম ভক্ত রঘু দাসজী!! জয় লীলাময় শ্রীজগন্নাথ!!