
“হেফাজত প্রধানমন্ত্রীকে যতবার ধন্যবাদ জানায়, আমি ততবার মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের পরাজয় দেখি”
নারীশাসক সরানোর দাবি মোকাবেলা করতে পারবেন তো?
কাবেরী গায়েন
বেশ অনেকদিন ধরেই শুনছিলাম, হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে ন্যায়বিচারের প্রতিমূর্তি হিসেবে গ্রীক দেবি থেমিসের যে ভাস্কর্যটি আছে, সেটি সরিয়ে ফেলার দাবি করেছে হেফাজতে ইসলাম। এ নিয়ে ফেসবুকে বেশ উত্তপ্ত পোস্ট পড়তে পড়তেই পত্রিকায় পড়লাম, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও জানিয়েছেন যে তিনিও এই ভাস্কর্যটি থাকা সমর্থন করেন না। কারণ, গ্রীক দেবি তো আমাদের দেশের কেউ না। তায় আবার শাড়ি পরা। হাতে তলোয়ারধরা। বোঝা গেলো, এই ভাস্কর্য সরিয়ে দেয়া হবে। এবং অবধারিতভাবে, ‘পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ’; তাই একদল বিদগ্ধ শিল্পসমালোচক বের হলেন হঠাৎ করেই। তাঁরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এই ভাস্কর্যের নান্দনিক মান নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করলেন। কেউ বা একধাপ বাড়িয়ে ভাস্কর মৃণাল হকের ‘কর্পোরেট শিল্পীসত্তা’, তাঁর ‘অখাদ্য’ নির্মাণ নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন। লেখা বাহুল্য, এদের মধ্যে আমার অনেক পছন্দের মানুষজনও আছেন। তাঁরা অনেকেই সাম্প্রদায়িক নন, আমার জানামতে।
‘রাতের অন্ধকারে’ এই ভাস্কর্যটি সরিয়ে নেয়া হলো ২৬ মে ২০১৭। অনেকেই টেলিভিশনে সরাসরি দেখলেন এই সরিয়ে নেবার গোটা ঘটনা, আমি দেখলাম ফেসবুকের তুমুল তীব্র-তীক্ষ্ণ স্ট্যাটাসে। হাহাকারে। অভিসম্পাতে। কিন্তু এসব তীক্ষ্ণ বাক্যবাণের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাধর কিংবা বলা ভালো, দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাবান মহল থেকে সুচারুভাবে এই ভাস্কর্য অপসারণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলো। ভাস্কর মৃণাল হককেই দায়িত্ব দেয়া হলো, ঠিকভাবে দেখভাল করে ভাস্কর্য সরিয়ে নেবার কাজটি সম্পন্ন করার। তিনি ‘চোখের জলে ভেসে’ নিজের করা ভাস্কর্য সরিয়ে নিতে সাহায্য করলেন। গুটিকয় যে ছেলেমেয়ে সেই রাতে জড়ো হয়েছিলেন এই অপসারণের প্রতিবাদে, তাঁদের প্রতিবাদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনবদ্য। ওটুকুই থাকবে দলিলে যে,এই ভাস্কর্য সরিয়ে নেবার সময়ে এদেশের তরুণদের কেউ কেউ প্রতিবাদ করেছিলেন। এই প্রতিবাদটুকুর মূল্য তাই অপরিসীম। প্রতিবাদ একটু একটু করে বেড়েছে। ছাত্রইউনিয়ন নেতা লিটন নন্দী আর উদীচীর আরিফকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গারদের ওপারে ওদের হাসিমুখই একমাত্র আশাজাগানিয়া ছবি। বাকি সব অন্ধকার।
এই ভাস্কর্য সরিয়ে নেয়া প্রসঙ্গে জনপরিসরে আলোচিত কয়েকটি বিষয়ে কথা বলার জন্যই এই লেখা। বলা যায়, সময়ের একটা নোট নিয়ে রাখা। বিশেষ করে এই অপসারণের পক্ষে যে যুক্তিগুলো উঠেছে তথাকথিত প্রগতিশীল বলয়ে, সেই যুক্তিগুলো একটু খোলা মনে দেখে নিতে চাই প্রথমে। এর পরে না হয় বোঝার চেষ্টা করা যাবে কী হলো, কী হতে যাচ্ছে।
এক। সবচেয়ে বেশি আলোচিত যুক্তি হচ্ছে, এই ভাস্কর্যটি নান্দনিক বিচারে খুব নীচু মানের। এই যুক্তিটি দিচ্ছেন তাঁরা, যাঁরা ঠিক ধর্মীয় গোঁড়ামির কারনে এসব ‘মূর্তি’ ভেংঙ্গে ফেলতে চান, এমন নন। তাঁরা বরং সরকার সমর্থক। সরকারের এই কাজে তুমুল সমালোচনা হতে পারে জেনে তাঁরা আগাম ব্যবস্থা হিসেবে, প্রধানমন্ত্রীর ইশারার পর থেকেই এই কথাগুলো বলছেন। আমার নিরীহ প্রশ্ন, তাঁদের বিদগ্ধ মনসমূহ কি হেফাজতের দাবির আগে, কিংবা প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের আগে এই নীচুমান দেখতে পায় নি? এই ভাস্কর্যই কি কেবল নীচুমানের বাংলাদেশে? ঢাকা শহর জুড়ে, সারা দেশ জুড়ে ভাস্কর্যের নামে বিপুল পরিমানের চুন-সুরকি আর সাদা রঙ্গের কিছু আখাম্বা অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে। সবচেয়ে হাস্যকর সম্ভবত ফুলার রোড আর পলাশীর ভেতরের একটা বিশাল জায়গায় অজস্র ভাস্কর্য নামের কসরত। কই, তখন তো তাঁদের বিদগ্ধ মন বিচলিত হচ্ছে না! না কি তাঁদের সমালোচক সত্ত্বা অপেক্ষা করছে হেফাজতের দাবির জন্য? মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীর ইশারার জন্য? সত্য হলো, বাংলাদেশে ভালো ভাস্কর্য খুব কম। সেইজন্য এসব ভেঙ্গে ফেলায় মদত দিতে হবে? কেউ কবিতা ভালো লেখেন না বলে, কবিতা পুড়িয়ে ফেলতে হবে? অনেকের গান ভালো হয় না বলে শিল্পীকে দিয়ে তাঁর গানের রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলতে হবে? অদ্ভূত যুক্তি! বিশেষ করে, হেফাজতের দাবির পরে যখন এটি আর কেবল ভাস্কর্য নয়, একটি রাজনৈতিক মতাদর্শিক প্রশ্নের মীমাংসাবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে!
দুই। এই যুক্তিও ভাস্করকে ঘিরেই। তিনিই না কি পটিয়ে, উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ঈদগাহ ময়দানের বিপরীতে এই ভাস্কর্যটি স্থাপন করিয়েছেন সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য। কী আশ্চর্য! আদালত প্রাঙ্গণে একটা ভাস্কর্য একজন ভাস্কর চাইলেই স্থাপন করতে পারেন! একজন ভাস্কর একা তো দূরে থাক, চলুন তো দেশের সব সাহিত্যিক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী-গায়ক-টকশোজীবী-পেশাজীবী সবাই মিলে কোন একটা ভাস্কর্য ওই চত্বরে স্থাপন করতে পারি কি না, আদালতের লোকজনদের অনুমতি ছাড়া! চ্যালেঞ্জ করছি। যাঁরা এটিকে মৃণাল হকের একক ‘ফেরেববাজি’ বলে চালাতে চাইছেন, তারা কিল খেয়ে কিল চুরি করছেন। রীতিমত মিটিং করে, পরিকল্পনা করে, শিল্পী নির্বাচন করে এমন সব কাজ করা হয়। শিক্ষিত বিবেচক মানুষরাও যখন কেবল মৃণাল হককেই দায়ী করেন একটা ‘অসুন্দর’ জিনিসকে আদালতের মত ‘পবিত্র’ জায়গায়, তারচেয়েও পবিত্র ঈদ্গাহ ময়দানের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দেবার জন্য, তখন অবাক হয়ে ভাবি, এইসব বড় ভাইদের সাথে না এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে গিয়ে পরিচয়? এদের সাথেই না প্রগতিশীল আন্দোলন নিয়ে কত আলোচনা হয়েছে! দলদাসত্ব করতে গিয়ে এমন দুর্ববল যুক্তি তাঁরা দিতে পারেন, এ অকল্পনীয়।
তিন। তৃতীয় যুক্তিটি উঠছে ‘আরো প্রগতিশীল’ একটা অংশ থেকে, তাঁরা বলছেন, গ্রীসের ন্যায়ের প্রতিমূর্তি দেবির সাথে আমাদের সংস্কৃতির কী সম্পর্ক? এই প্রশ্ন আর হেফাজতের দাবির ভেতর আমি কোন পার্থক্য পাই না। হেফাজত বরং অকপট। দেশীত্বের ধুঁয়া তুললে কাপড় পরার ধরন, চেয়ার-টেবিলে খাওয়া, পাশ্চাত্য ধারার গণতন্ত্র, নির্বাচন-ব্যবস্থা,গণতান্ত্রিক প্রতিষ্টঠান, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাভ্যাস- সবকিছু বর্জন কেনো করি না? দেবির মূর্তি একটি প্রতীক, ন্যায়ের ধারনার; কিন্তু দেবির মূর্তি সরানোর সমর্থনের অন্তর্গত কারণে খুব বেশি পার্থক্য নেই হেফাজতি মন আর ‘অতি-প্রগতিশীল’ মনে। কারণটা আদি এবং অকৃত্রিম। মূর্তি ভাঙ্গার তাড়না।
চার। ‘মূর্তি’ বনাম ‘ভাস্কর্য’। বেশ জোরেশোরে আলোচনা হচ্ছে, আরে এটা তো মূর্তি না, এটা ভাস্কর্য। জনপরিসরে একটা বিষয় পরিষ্কার এই যুক্তির ভেতর দিয়ে, জেনে কিংবা না-জেনে, সেটা হলো, সবাই কনভিন্সড, মূর্তি ভাংগার জিনিস, ভাস্কর্য নয়। যদি কাঠামোগতভাবে দেখি, তবে উপকরণের পার্থক্য ছাড়া এদেশে পূজার জন্য যে প্রতিমা নির্মাণ করা হয়, আর ভাস্কর্য নামে যা প্রচলিত- এ দুয়ের কোন পার্থক্য নেই। তবে কংক্রিট, লোহা, পাথরের মূর্তিও কম নেই। কাঠামোতে মূর্ত হয় বলে দুইই মূর্তি। আর ভাবের দিক থেকে দেখলে, কোন ভাব-ধারণা-প্রকাশ যা মূর্ত বা প্রকাশিত, তাই মূর্তি। এজন্য আমরা বলি ভাবমূর্তি। দেশের, ধর্মের, পরিবারের, ব্যক্তির ভাবমূর্তি ধরে রাখা নিয়ে আমাদের চিন্তার অন্ত নেই। অথচ অন্য ধর্মাবলম্বীর উপাসনার ‘মূর্তি’ (প্রতিমা) ভেঙ্গে ফেলা জায়েজ। এমনকি যারা আন্তরিকভাবে ভাস্কর্য রক্ষার জন্য প্রস্তুত, তারাও মূর্তি ভাঙ্গার ব্যাপারে উদাসীন। এ বিষয়ে আমার মনে আছে, যেবার বাউল ভাস্কর্য ভাঙ্গা হলো, তখন বেশ কিছু আলোচনা হয়েছিলো এই বিষয়ে। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধু-সহকর্মী রোবায়েত ফেরদৌসের সাথে ‘মুক্তবুদ্ধি চর্চাকেন্দ্র’ নামের একটা আলোচনা কেন্দ্র চালাই। আমাদের এখান থেকেও ভাস্কর্য ভাঙ্গার বিপরীতে একটা সেমিনারের আয়োজন করা হলো। রোবায়েতের অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতায় অনেক বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব এলেন আলোচনায় এবং ঘুরে ফিরে অনেকেই বললেন ভাস্কর্য কেনো ভাঙ্গা হচ্ছে, এসব তো মূর্তি না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক চৌকষ অধ্যাপকও একই কথা বললেন। আর সি মজুমদার মিলনায়তন ভরে বাইরেও দাঁড়িয়ে আছেন দর্শক-শোতা। আমি অধ্যাপককে জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে কি ম্যাডাম, ভাস্কর্য ভাঙ্গা যায়না, কিন্তু মূর্তি ভাঙ্গা যায়?তিনি হেসে বললেন, ‘কাবেরী, এই প্রশ্নের উত্তর তোমাকে পরে দেবো।’ সেই অধ্যাপকের সাথে আমার পরে কত শতবার দেখা হয়েছে, তিনিও এ’প্রসংগ তোলেননি, আমিও তুলিনি তাঁকে লজ্জা দেবো না বলে। তিনি এখন অবসরে চলে গেছেন। আর দেখা হয় না। কিন্তু , আমাদের শহীদমিনারে তো ভাব মূর্ত হয়েছে যে মা তার শহীদ সন্তানদের আঁচল দিয়ে আগলে রেখেছেন। এই ভাব মূর্ত হওয়ায় পরে এটা কি মূর্তি, এটা কি ভাস্কর্য? কোনটা ভাঙ্গা যায়? কোনটা ভাঙ্গা যায় না? একই মূর্ততার কোনটাকে ভাঙ্গতে চাই আমরা?
এ বিষয়ে চমৎকার বলেছিলেন নজরুল সংগীত শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। একই সময়ের দিকে শিখা চিরন্তনী নিয়েও ঝামেলা চলছিলো। বলা হচ্ছিলো এটা ইসলামসম্মত নয়। হাক্কানী মিশনের এক আলোচনা সভায় তিনি বলেছিলেন, তাহলে ঘরে ঘরে রান্নার যে চুলা আছে, সেগুলো রাখেন কেনো?ভেঙ্গে দিলেই হয়! ওগুলো কি শিখা নয়?
পাঁচ। সরকারী দলের খুব যাঁরা অনুগত, অথচ এই ঘটনায় কষ্ট পাচ্চছেন,, তাঁরা আবার দোষ চাপিয়ে দিচ্ছেন প্রধান বিচারপতির উপর। তাঁরা খুব ভালো করেই জানেন, এই এজেন্ডা প্রধান বিচারপতির নয়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রেী হেফাজতের দাবির পরে এই ভাস্কর্য সরিয়ে দেবার ইশারা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এই মূর্তি তাঁরও পছন্দ নয়। তারপর থেকেই আয়োজন। এই ঘটনার ঐতিহাসিক মূল্য আমরা দেখতে থাকবো কেবল। এতবড় হবে সে পরিবর্তন যে তার দায়িত্ব কেবল প্রধান বিচারপতিকে দেয়া খুব কাজের হবে না। সরকারের সাথে প্রধান বিচারপতির দ্বন্দ্বটা ক্রমশ প্রকাশ্য হয়ে উঠছে বলেই তাঁর ঘাড়ে দায় চাপিয়ে নিষ্ক্ররৃতি পাবার সুযোগ কি আসলেই আছে? আহা! যদি থাকতো!
ছয়। এখন আসি মূল প্রসঙ্গে। নারীর অবয়ব নিয়ে দাঁড়ানো ন্যায়ের প্রতীক থেমিসের ভাস্কর্যকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। মূল যুক্তি ছিলো হেফাজতের এবং সরকারের যে, ঈদগাহের সামনে এই মূর্তি থাকলে ঈদের নামাজে সমস্যা হবে। সমস্যা কি অবয়ব বলে, না কি নারীর অবয়ব বলে? যদি নারীর অবয়ব সমস্যা হয়, তবে আমার এক মৃদু প্রশ্ন আছে, প্রতি বছর হজ্ব হয়, নারী-পুরুষ পাশাপাশি হজ্ব করেন। এই পদ্ধতি তো সেই শুরু থেকে চলে আসছে! হজ্বকারীদের নামাজ কি তবে হয় না? যাঁরা নামাজ পড়েন, তাঁদের অন্তরে কি মাতৃমুখ, স্ত্রেী-অবয়ব, মেয়ে সন্তানের অবয়ব বিরাজ করে না? সেইসব অবয়ব অন্তরে ধারণ করার জন্য কি তাঁদের নামাজ হয় না? এই পৃথিবীতে অবয়বহীন চরাচর কোথায় পাওয়া যাবে? সারা দেশে অসংখ্য ভাস্কর্যে অনেক নারীমুখ, নারী অবয়ব। কারণ, এদেশের সংস্কৃতিতে নারী খুব সম্মানিত না হলেও মাতৃরুপ সম্মানিত এবং নারী অসূর্যম্পর্শাও নয়। সেইসব ভাস্কর্যের আশেপাশে, পূর্বে-পশ্চিমে-উত্তরে-দক্ষিণে-ঈষানে-নৈঋ্তে যাঁরা বসবাস করেন, তাঁদের কি তবে নামাজ হয় না? এতোদিন হয়নি? দেবি থেমিসের ভাস্কর্য সরিয়ে দেবার ভেতর দিয়ে প্রধানমন্ত্রেী শেখ হাসিনা ন্যায়ের ধারনার প্রতীক সরিয়ে দেবার পাশাপাশি সরিয়ে দিলেন নারী অবয়ব। হেফাজত দাবি না করলে এই ভাস্কর্য সরানোর প্রশ্নই উঠতো না। এই নারী অবয়ব সরিয়ে দেবার প্রতীকী মূল্য নিয়েই তবে কথা হোক।
হেফাজতে ইসলাম আমাদের দেশের রাজনীতিতে নতুন প্রপঞ্চ। ২০১৩ সালের দিকে প্রথম দেখলাম হেফাজতে ইসলামের উত্থান। এই নামটা শুনলেই আমার মনে পড়ে ২০১৩ সালের ৮ মে’র কথা। লাখে লাখে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিহিত মানুষেরা ঢাকা শহর দখল করেছেন। সেই কাফেলায় একটি মেয়েও ছিলো না। কী উত্তেজক কথাবার্তা! নারী-শাসন চলবে না, দেশ যে আইনে, যে পদ্ধতিতে চলছে, সবকিছুর বিরোধিতা তারা করলেন। তারপর তারা ঢাকা শহরের বিনাশ সাধন শুরু করলেন। রাস্তা খুঁড়ে, গাছ কেটে এক দক্ষযজ্ঞ বাধিয়ে তুললেন। নারীদের কাজে যাবার বিরুদ্ধে,নারীর শিক্ষার বিরুদ্ধে বলেই তারা ক্ষান্ত হননি, কেনো সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়েছিলো, সেই অপরাধে আমারদের ছাত্রী,একুশে টেলিভিশনের সাংবাদিক নাদিয়া শারমিনের উপর কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো হেফাজতের পুরুষেরা আর নাদিয়ার সেই মুখ- প্রধানমন্ত্রী কীভাবে ভুলে যেতে পারেন? একজন নারী সাংবাদিককে নেকড়ের মতো হিংস্র একদল মানুষ তাড়াচ্ছে ,আর নাদিয়া প্রাণভয়ে ছুটছে- হেফাজতকে বোঝার জন্য এই ছবিটি-ই কি যথেষ্ট নয়? তারপর এলো হেফাজতের ১৩ দফা। হেফাজতের ১৩ দফা সরাসরি নারীকে ঘরে ঢুকিয়ে দেবার ডাক। তারা বললো, মেয়েদের থ্রি-ফোরের বেশি পড়ার দরকার নেই। বলল, যেসব নারী বাইরে কাজ করে, তাদের চরিত্রের ঠিক নেই। মোল্লা শফী বললেন, মেয়েরা হচ্চছে তেঁতুলের মত। এসব কথা কীভাবে ভোলা সম্ভব?প্রধানমন্ত্রেীর মনে থাকার কথা, বাংলাদেশের নারী সমাজ বিশাল সমাবেশ করলেন পল্টনে। হাজার হাজার নারী এই হেফাজতের আস্ফালনকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। সমর্তথন দিয়েছিলেন নারী-নেতৃত্বকে।
আজ ভাস্কর মৃণাল হককে দিয়েই নিজের বানানো ভাস্কর্য ভেঙ্গে দেয়া হলো। হতেই পারে, ভাস্কর মৃণাল হক ভাস্কর হিসেবে বা মানুষ হিসেবে খুব কমিটেড নন। কিন্তু স্রষ্টাকে দিয়ে তাঁর শিল্পকর্ম ভাঙ্গানো!হেফাজতিরা ঠিক যেমন প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েই ভাঙ্গিয়ে নিলেন ন্যায়পরায়নতার প্রতীক নারীকে। নারীকে দিয়েই নারীপ্রতীককে সরিয়ে যুগে যুগে নারীর ক্ষমতার উপর খড়্গহস্ত নেমে এসেছে। নারী নিজেই বহন করেছে নিজেকে পরাজিত করার প্রতীক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রেী খুব ভালো করেই জানেন, হেফাজতে ইসলামের রাজনীতি কী, নারী প্রসঙ্গে তাদের অবস্থান। জেনেশুনে হেফাজতের দাবির কাছে এই নতি স্বীকার এখন আর একটি ভাস্কর্য সরানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। আজ হেফাজত প্রধানমন্ত্রেীকে তাঁর নতি স্বীকারের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছে, সেইসাথে সকল ভাস্কর্য সরিয়ে নেবার দাবি করেছে। হেফাজত যতবার ধন্যবাদ জানায়, আমি ততবার মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের পরাজয় দেখি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রেী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত কোন না কোন মূল্যবোধের সাথে আপোষ করেই এই ধন্যবাদ পান। তিনি সর্বোচ্চ সাধুবাদ পাবেন, যেদিন তিনি তাদের দাবি মেনে ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন। সেই দাবি এলো বলে। তিনি পারবেন তো হেফাজতের সেই নারী-শাসক সরানোর দাবি সামলাতে?
বেশ অনেকদিন ধরেই শুনছিলাম, হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে ন্যায়বিচারের প্রতিমূর্তি হিসেবে গ্রীক দেবি থেমিসের যে ভাস্কর্যটি আছে, সেটি সরিয়ে ফেলার দাবি করেছে হেফাজতে ইসলাম। এ নিয়ে ফেসবুকে বেশ উত্তপ্ত পোস্ট পড়তে পড়তেই পত্রিকায় পড়লাম, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও জানিয়েছেন যে তিনিও এই ভাস্কর্যটি থাকা সমর্থন করেন না। কারণ, গ্রীক দেবি তো আমাদের দেশের কেউ না। তায় আবার শাড়ি পরা। হাতে তলোয়ারধরা। বোঝা গেলো, এই ভাস্কর্য সরিয়ে দেয়া হবে। এবং অবধারিতভাবে, ‘পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ’; তাই একদল বিদগ্ধ শিল্পসমালোচক বের হলেন হঠাৎ করেই। তাঁরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এই ভাস্কর্যের নান্দনিক মান নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করলেন। কেউ বা একধাপ বাড়িয়ে ভাস্কর মৃণাল হকের ‘কর্পোরেট শিল্পীসত্তা’, তাঁর ‘অখাদ্য’ নির্মাণ নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন। লেখা বাহুল্য, এদের মধ্যে আমার অনেক পছন্দের মানুষজনও আছেন। তাঁরা অনেকেই সাম্প্রদায়িক নন, আমার জানামতে।
‘রাতের অন্ধকারে’ এই ভাস্কর্যটি সরিয়ে নেয়া হলো ২৬ মে ২০১৭। অনেকেই টেলিভিশনে সরাসরি দেখলেন এই সরিয়ে নেবার গোটা ঘটনা, আমি দেখলাম ফেসবুকের তুমুল তীব্র-তীক্ষ্ণ স্ট্যাটাসে। হাহাকারে। অভিসম্পাতে। কিন্তু এসব তীক্ষ্ণ বাক্যবাণের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাধর কিংবা বলা ভালো, দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাবান মহল থেকে সুচারুভাবে এই ভাস্কর্য অপসারণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলো। ভাস্কর মৃণাল হককেই দায়িত্ব দেয়া হলো, ঠিকভাবে দেখভাল করে ভাস্কর্য সরিয়ে নেবার কাজটি সম্পন্ন করার। তিনি ‘চোখের জলে ভেসে’ নিজের করা ভাস্কর্য সরিয়ে নিতে সাহায্য করলেন। গুটিকয় যে ছেলেমেয়ে সেই রাতে জড়ো হয়েছিলেন এই অপসারণের প্রতিবাদে, তাঁদের প্রতিবাদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনবদ্য। ওটুকুই থাকবে দলিলে যে,এই ভাস্কর্য সরিয়ে নেবার সময়ে এদেশের তরুণদের কেউ কেউ প্রতিবাদ করেছিলেন। এই প্রতিবাদটুকুর মূল্য তাই অপরিসীম। প্রতিবাদ একটু একটু করে বেড়েছে। ছাত্রইউনিয়ন নেতা লিটন নন্দী আর উদীচীর আরিফকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গারদের ওপারে ওদের হাসিমুখই একমাত্র আশাজাগানিয়া ছবি। বাকি সব অন্ধকার।
এই ভাস্কর্য সরিয়ে নেয়া প্রসঙ্গে জনপরিসরে আলোচিত কয়েকটি বিষয়ে কথা বলার জন্যই এই লেখা। বলা যায়, সময়ের একটা নোট নিয়ে রাখা। বিশেষ করে এই অপসারণের পক্ষে যে যুক্তিগুলো উঠেছে তথাকথিত প্রগতিশীল বলয়ে, সেই যুক্তিগুলো একটু খোলা মনে দেখে নিতে চাই প্রথমে। এর পরে না হয় বোঝার চেষ্টা করা যাবে কী হলো, কী হতে যাচ্ছে।
এক। সবচেয়ে বেশি আলোচিত যুক্তি হচ্ছে, এই ভাস্কর্যটি নান্দনিক বিচারে খুব নীচু মানের। এই যুক্তিটি দিচ্ছেন তাঁরা, যাঁরা ঠিক ধর্মীয় গোঁড়ামির কারনে এসব ‘মূর্তি’ ভেংঙ্গে ফেলতে চান, এমন নন। তাঁরা বরং সরকার সমর্থক। সরকারের এই কাজে তুমুল সমালোচনা হতে পারে জেনে তাঁরা আগাম ব্যবস্থা হিসেবে, প্রধানমন্ত্রীর ইশারার পর থেকেই এই কথাগুলো বলছেন। আমার নিরীহ প্রশ্ন, তাঁদের বিদগ্ধ মনসমূহ কি হেফাজতের দাবির আগে, কিংবা প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের আগে এই নীচুমান দেখতে পায় নি? এই ভাস্কর্যই কি কেবল নীচুমানের বাংলাদেশে? ঢাকা শহর জুড়ে, সারা দেশ জুড়ে ভাস্কর্যের নামে বিপুল পরিমানের চুন-সুরকি আর সাদা রঙ্গের কিছু আখাম্বা অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে। সবচেয়ে হাস্যকর সম্ভবত ফুলার রোড আর পলাশীর ভেতরের একটা বিশাল জায়গায় অজস্র ভাস্কর্য নামের কসরত। কই, তখন তো তাঁদের বিদগ্ধ মন বিচলিত হচ্ছে না! না কি তাঁদের সমালোচক সত্ত্বা অপেক্ষা করছে হেফাজতের দাবির জন্য? মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীর ইশারার জন্য? সত্য হলো, বাংলাদেশে ভালো ভাস্কর্য খুব কম। সেইজন্য এসব ভেঙ্গে ফেলায় মদত দিতে হবে? কেউ কবিতা ভালো লেখেন না বলে, কবিতা পুড়িয়ে ফেলতে হবে? অনেকের গান ভালো হয় না বলে শিল্পীকে দিয়ে তাঁর গানের রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলতে হবে? অদ্ভূত যুক্তি! বিশেষ করে, হেফাজতের দাবির পরে যখন এটি আর কেবল ভাস্কর্য নয়, একটি রাজনৈতিক মতাদর্শিক প্রশ্নের মীমাংসাবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে!
দুই। এই যুক্তিও ভাস্করকে ঘিরেই। তিনিই না কি পটিয়ে, উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ঈদগাহ ময়দানের বিপরীতে এই ভাস্কর্যটি স্থাপন করিয়েছেন সরকারকে বিপদে ফেলার জন্য। কী আশ্চর্য! আদালত প্রাঙ্গণে একটা ভাস্কর্য একজন ভাস্কর চাইলেই স্থাপন করতে পারেন! একজন ভাস্কর একা তো দূরে থাক, চলুন তো দেশের সব সাহিত্যিক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবী-গায়ক-টকশোজীবী-পেশাজীবী সবাই মিলে কোন একটা ভাস্কর্য ওই চত্বরে স্থাপন করতে পারি কি না, আদালতের লোকজনদের অনুমতি ছাড়া! চ্যালেঞ্জ করছি। যাঁরা এটিকে মৃণাল হকের একক ‘ফেরেববাজি’ বলে চালাতে চাইছেন, তারা কিল খেয়ে কিল চুরি করছেন। রীতিমত মিটিং করে, পরিকল্পনা করে, শিল্পী নির্বাচন করে এমন সব কাজ করা হয়। শিক্ষিত বিবেচক মানুষরাও যখন কেবল মৃণাল হককেই দায়ী করেন একটা ‘অসুন্দর’ জিনিসকে আদালতের মত ‘পবিত্র’ জায়গায়, তারচেয়েও পবিত্র ঈদ্গাহ ময়দানের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দেবার জন্য, তখন অবাক হয়ে ভাবি, এইসব বড় ভাইদের সাথে না এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে গিয়ে পরিচয়? এদের সাথেই না প্রগতিশীল আন্দোলন নিয়ে কত আলোচনা হয়েছে! দলদাসত্ব করতে গিয়ে এমন দুর্ববল যুক্তি তাঁরা দিতে পারেন, এ অকল্পনীয়।
তিন। তৃতীয় যুক্তিটি উঠছে ‘আরো প্রগতিশীল’ একটা অংশ থেকে, তাঁরা বলছেন, গ্রীসের ন্যায়ের প্রতিমূর্তি দেবির সাথে আমাদের সংস্কৃতির কী সম্পর্ক? এই প্রশ্ন আর হেফাজতের দাবির ভেতর আমি কোন পার্থক্য পাই না। হেফাজত বরং অকপট। দেশীত্বের ধুঁয়া তুললে কাপড় পরার ধরন, চেয়ার-টেবিলে খাওয়া, পাশ্চাত্য ধারার গণতন্ত্র, নির্বাচন-ব্যবস্থা,গণতান্ত্রিক প্রতিষ্টঠান, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাভ্যাস- সবকিছু বর্জন কেনো করি না? দেবির মূর্তি একটি প্রতীক, ন্যায়ের ধারনার; কিন্তু দেবির মূর্তি সরানোর সমর্থনের অন্তর্গত কারণে খুব বেশি পার্থক্য নেই হেফাজতি মন আর ‘অতি-প্রগতিশীল’ মনে। কারণটা আদি এবং অকৃত্রিম। মূর্তি ভাঙ্গার তাড়না।
চার। ‘মূর্তি’ বনাম ‘ভাস্কর্য’। বেশ জোরেশোরে আলোচনা হচ্ছে, আরে এটা তো মূর্তি না, এটা ভাস্কর্য। জনপরিসরে একটা বিষয় পরিষ্কার এই যুক্তির ভেতর দিয়ে, জেনে কিংবা না-জেনে, সেটা হলো, সবাই কনভিন্সড, মূর্তি ভাংগার জিনিস, ভাস্কর্য নয়। যদি কাঠামোগতভাবে দেখি, তবে উপকরণের পার্থক্য ছাড়া এদেশে পূজার জন্য যে প্রতিমা নির্মাণ করা হয়, আর ভাস্কর্য নামে যা প্রচলিত- এ দুয়ের কোন পার্থক্য নেই। তবে কংক্রিট, লোহা, পাথরের মূর্তিও কম নেই। কাঠামোতে মূর্ত হয় বলে দুইই মূর্তি। আর ভাবের দিক থেকে দেখলে, কোন ভাব-ধারণা-প্রকাশ যা মূর্ত বা প্রকাশিত, তাই মূর্তি। এজন্য আমরা বলি ভাবমূর্তি। দেশের, ধর্মের, পরিবারের, ব্যক্তির ভাবমূর্তি ধরে রাখা নিয়ে আমাদের চিন্তার অন্ত নেই। অথচ অন্য ধর্মাবলম্বীর উপাসনার ‘মূর্তি’ (প্রতিমা) ভেঙ্গে ফেলা জায়েজ। এমনকি যারা আন্তরিকভাবে ভাস্কর্য রক্ষার জন্য প্রস্তুত, তারাও মূর্তি ভাঙ্গার ব্যাপারে উদাসীন। এ বিষয়ে আমার মনে আছে, যেবার বাউল ভাস্কর্য ভাঙ্গা হলো, তখন বেশ কিছু আলোচনা হয়েছিলো এই বিষয়ে। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধু-সহকর্মী রোবায়েত ফেরদৌসের সাথে ‘মুক্তবুদ্ধি চর্চাকেন্দ্র’ নামের একটা আলোচনা কেন্দ্র চালাই। আমাদের এখান থেকেও ভাস্কর্য ভাঙ্গার বিপরীতে একটা সেমিনারের আয়োজন করা হলো। রোবায়েতের অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতায় অনেক বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব এলেন আলোচনায় এবং ঘুরে ফিরে অনেকেই বললেন ভাস্কর্য কেনো ভাঙ্গা হচ্ছে, এসব তো মূর্তি না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক চৌকষ অধ্যাপকও একই কথা বললেন। আর সি মজুমদার মিলনায়তন ভরে বাইরেও দাঁড়িয়ে আছেন দর্শক-শোতা। আমি অধ্যাপককে জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে কি ম্যাডাম, ভাস্কর্য ভাঙ্গা যায়না, কিন্তু মূর্তি ভাঙ্গা যায়?তিনি হেসে বললেন, ‘কাবেরী, এই প্রশ্নের উত্তর তোমাকে পরে দেবো।’ সেই অধ্যাপকের সাথে আমার পরে কত শতবার দেখা হয়েছে, তিনিও এ’প্রসংগ তোলেননি, আমিও তুলিনি তাঁকে লজ্জা দেবো না বলে। তিনি এখন অবসরে চলে গেছেন। আর দেখা হয় না। কিন্তু , আমাদের শহীদমিনারে তো ভাব মূর্ত হয়েছে যে মা তার শহীদ সন্তানদের আঁচল দিয়ে আগলে রেখেছেন। এই ভাব মূর্ত হওয়ায় পরে এটা কি মূর্তি, এটা কি ভাস্কর্য? কোনটা ভাঙ্গা যায়? কোনটা ভাঙ্গা যায় না? একই মূর্ততার কোনটাকে ভাঙ্গতে চাই আমরা?
এ বিষয়ে চমৎকার বলেছিলেন নজরুল সংগীত শিল্পী সাদিয়া আফরিন মল্লিক। একই সময়ের দিকে শিখা চিরন্তনী নিয়েও ঝামেলা চলছিলো। বলা হচ্ছিলো এটা ইসলামসম্মত নয়। হাক্কানী মিশনের এক আলোচনা সভায় তিনি বলেছিলেন, তাহলে ঘরে ঘরে রান্নার যে চুলা আছে, সেগুলো রাখেন কেনো?ভেঙ্গে দিলেই হয়! ওগুলো কি শিখা নয়?
পাঁচ। সরকারী দলের খুব যাঁরা অনুগত, অথচ এই ঘটনায় কষ্ট পাচ্চছেন,, তাঁরা আবার দোষ চাপিয়ে দিচ্ছেন প্রধান বিচারপতির উপর। তাঁরা খুব ভালো করেই জানেন, এই এজেন্ডা প্রধান বিচারপতির নয়। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রেী হেফাজতের দাবির পরে এই ভাস্কর্য সরিয়ে দেবার ইশারা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এই মূর্তি তাঁরও পছন্দ নয়। তারপর থেকেই আয়োজন। এই ঘটনার ঐতিহাসিক মূল্য আমরা দেখতে থাকবো কেবল। এতবড় হবে সে পরিবর্তন যে তার দায়িত্ব কেবল প্রধান বিচারপতিকে দেয়া খুব কাজের হবে না। সরকারের সাথে প্রধান বিচারপতির দ্বন্দ্বটা ক্রমশ প্রকাশ্য হয়ে উঠছে বলেই তাঁর ঘাড়ে দায় চাপিয়ে নিষ্ক্ররৃতি পাবার সুযোগ কি আসলেই আছে? আহা! যদি থাকতো!
ছয়। এখন আসি মূল প্রসঙ্গে। নারীর অবয়ব নিয়ে দাঁড়ানো ন্যায়ের প্রতীক থেমিসের ভাস্কর্যকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। মূল যুক্তি ছিলো হেফাজতের এবং সরকারের যে, ঈদগাহের সামনে এই মূর্তি থাকলে ঈদের নামাজে সমস্যা হবে। সমস্যা কি অবয়ব বলে, না কি নারীর অবয়ব বলে? যদি নারীর অবয়ব সমস্যা হয়, তবে আমার এক মৃদু প্রশ্ন আছে, প্রতি বছর হজ্ব হয়, নারী-পুরুষ পাশাপাশি হজ্ব করেন। এই পদ্ধতি তো সেই শুরু থেকে চলে আসছে! হজ্বকারীদের নামাজ কি তবে হয় না? যাঁরা নামাজ পড়েন, তাঁদের অন্তরে কি মাতৃমুখ, স্ত্রেী-অবয়ব, মেয়ে সন্তানের অবয়ব বিরাজ করে না? সেইসব অবয়ব অন্তরে ধারণ করার জন্য কি তাঁদের নামাজ হয় না? এই পৃথিবীতে অবয়বহীন চরাচর কোথায় পাওয়া যাবে? সারা দেশে অসংখ্য ভাস্কর্যে অনেক নারীমুখ, নারী অবয়ব। কারণ, এদেশের সংস্কৃতিতে নারী খুব সম্মানিত না হলেও মাতৃরুপ সম্মানিত এবং নারী অসূর্যম্পর্শাও নয়। সেইসব ভাস্কর্যের আশেপাশে, পূর্বে-পশ্চিমে-উত্তরে-দক্ষিণে-ঈষানে-নৈঋ্তে যাঁরা বসবাস করেন, তাঁদের কি তবে নামাজ হয় না? এতোদিন হয়নি? দেবি থেমিসের ভাস্কর্য সরিয়ে দেবার ভেতর দিয়ে প্রধানমন্ত্রেী শেখ হাসিনা ন্যায়ের ধারনার প্রতীক সরিয়ে দেবার পাশাপাশি সরিয়ে দিলেন নারী অবয়ব। হেফাজত দাবি না করলে এই ভাস্কর্য সরানোর প্রশ্নই উঠতো না। এই নারী অবয়ব সরিয়ে দেবার প্রতীকী মূল্য নিয়েই তবে কথা হোক।
হেফাজতে ইসলাম আমাদের দেশের রাজনীতিতে নতুন প্রপঞ্চ। ২০১৩ সালের দিকে প্রথম দেখলাম হেফাজতে ইসলামের উত্থান। এই নামটা শুনলেই আমার মনে পড়ে ২০১৩ সালের ৮ মে’র কথা। লাখে লাখে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিহিত মানুষেরা ঢাকা শহর দখল করেছেন। সেই কাফেলায় একটি মেয়েও ছিলো না। কী উত্তেজক কথাবার্তা! নারী-শাসন চলবে না, দেশ যে আইনে, যে পদ্ধতিতে চলছে, সবকিছুর বিরোধিতা তারা করলেন। তারপর তারা ঢাকা শহরের বিনাশ সাধন শুরু করলেন। রাস্তা খুঁড়ে, গাছ কেটে এক দক্ষযজ্ঞ বাধিয়ে তুললেন। নারীদের কাজে যাবার বিরুদ্ধে,নারীর শিক্ষার বিরুদ্ধে বলেই তারা ক্ষান্ত হননি, কেনো সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়েছিলো, সেই অপরাধে আমারদের ছাত্রী,একুশে টেলিভিশনের সাংবাদিক নাদিয়া শারমিনের উপর কীভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো হেফাজতের পুরুষেরা আর নাদিয়ার সেই মুখ- প্রধানমন্ত্রী কীভাবে ভুলে যেতে পারেন? একজন নারী সাংবাদিককে নেকড়ের মতো হিংস্র একদল মানুষ তাড়াচ্ছে ,আর নাদিয়া প্রাণভয়ে ছুটছে- হেফাজতকে বোঝার জন্য এই ছবিটি-ই কি যথেষ্ট নয়? তারপর এলো হেফাজতের ১৩ দফা। হেফাজতের ১৩ দফা সরাসরি নারীকে ঘরে ঢুকিয়ে দেবার ডাক। তারা বললো, মেয়েদের থ্রি-ফোরের বেশি পড়ার দরকার নেই। বলল, যেসব নারী বাইরে কাজ করে, তাদের চরিত্রের ঠিক নেই। মোল্লা শফী বললেন, মেয়েরা হচ্চছে তেঁতুলের মত। এসব কথা কীভাবে ভোলা সম্ভব?প্রধানমন্ত্রেীর মনে থাকার কথা, বাংলাদেশের নারী সমাজ বিশাল সমাবেশ করলেন পল্টনে। হাজার হাজার নারী এই হেফাজতের আস্ফালনকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। সমর্তথন দিয়েছিলেন নারী-নেতৃত্বকে।
আজ ভাস্কর মৃণাল হককে দিয়েই নিজের বানানো ভাস্কর্য ভেঙ্গে দেয়া হলো। হতেই পারে, ভাস্কর মৃণাল হক ভাস্কর হিসেবে বা মানুষ হিসেবে খুব কমিটেড নন। কিন্তু স্রষ্টাকে দিয়ে তাঁর শিল্পকর্ম ভাঙ্গানো! হেফাজতিরা ঠিক যেমন প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েই ভাঙ্গিয়ে নিলেন ন্যায়পরায়নতার প্রতীক নারীকে। নারীকে দিয়েই নারীপ্রতীককে সরিয়ে যুগে যুগে নারীর ক্ষমতার উপর খর্গহস্ত নেমে এসেছে। নারী নিজেই বহন করেছে নিজেকে পরাজিত করার প্রতীক। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খুব ভালো করেই জানেন, হেফাজতে ইসলামের রাজনীতি কী, নারী প্রসঙ্গে তাদের অবস্থান। জেনেশুনে হেফাজতের দাবির কাছে এই নতি স্বীকার এখন আর একটি ভাস্কর্য সরানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। আজ হেফাজত প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর নতি স্বীকারের জন্য অভিনন্দন জানিয়েছে, সেইসাথে সকল ভাস্কর্য সরিয়ে নেবার দাবি করেছে। হেফাজত যতবার ধন্যবাদ জানায়, আমি ততবার মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের পরাজয় দেখি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত কোন না কোন মূল্যবোধের সাথে আপোষ করেই এই ধন্যবাদ পান। তিনি সর্বোচ্চ সাধুবাদ পাবেন, যেদিন তিনি তাদের দাবি মেনে ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন। সেই দাবি এলো বলে। তিনি পারবেন তো হেফাজতের সেই নারী-শাসক সরানোর দাবি সামলাতে?